জর্জ ফ্লয়েড আন্দোলন: নৃশংস ঔপনিবেশিক অতীত নিয়ে বেলজিয়ামে দাঙ্গা

Spread the love

বাংলা সংলাপ ডেস্কঃ ব্রাসেলসে প্রাসাদোপম আফ্রিকা যাদুঘরের ভেতর রাজা দ্বিতীয় লিওপল্ডের একাধিক মূর্তি রয়েছে।

তেমন একটি মূর্তির পাশে দাঁড়িয়ে একজন দর্শনার্থী বিবিসির সাংবাদিক জর্জিনা রানার্ডকে বলেন, “শহরের ভেতর তার একটি মূর্তিকে অবমাননার ঘটনার আগে রাজা দ্বিতীয় লিওপল্ড সম্পর্কে তেমন কিছুই জানতাম না।“

আইনের কারণে যাদুঘরের ভেতর সাবেক এই রাজার মূর্তির গায়ে কারো আঁচড় লাগানোর উপায় নেই, কিন্তু বাইরে তার স্মৃতিস্তম্ভগুলোর কোনো আইনি সুরক্ষা নেই এবং একের পর এক হামলার শিকার হচ্ছে ।

গত সপ্তাহে অ্যান্টওয়ার্প শহরে রাজা দ্বিতীয় লিওপল্ডের একটি মূর্তিতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। গেণ্ট এবং অসটেন্ড শহরে তার মূর্তিতে লাল রঙ লেপে দেওয়া হয়।

আঠারোশ পঁয়ষট্টি সালে রাজা লিওপল্ড মধ্য আফ্রিকায় বিশাল একটি এলাকা দখল করে ঔপনিবেশিক শাসন শুরু করেছিলেন। সে সময় তার নৃশংসতার সব কাহিনী গা শিউরে ওঠার মতো।

বিশেষ করে বর্তমান গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রে তিনি এতই অত্যাচার নির্যাতন চালিয়েছিলেন যে তৎকালীন অন্য ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শাসকরাও তার নিন্দা করেন।

কিন্তু নিজের দেশে বেলজিয়ামে তার কাঁটাছেড়া কখনই তেমন হয়নি।

দুহাজার আঠারো সালে বড় ধরনের ঘষামাজার আগ পর্যন্ত বেলজিয়ামের আফ্রিকা যাদুঘর ছিল ‘সর্বশেষ ঔপনিবেশিক যাদুঘর‘।

গত সপ্তাহে বিশ্বের অনেক দেশের মত বেলজিয়ামেও হাজার হাজার মানুষ যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের হাতে কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ শুরু করে।

“হঠাৎ যেন সবাই ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠলো, অতীতের দিকে তাকাতে শুরু করেছে মানুষ, “ বিবিসিকে বলছেন ব্রাসেলসে কঙ্গো বংশোদ্ভূত একজন মানবাধিকার আইনজীবী ডেবোরা কায়ামবি।

মানুষের আক্রোশ গিয়ে পড়েছে রাজার মূর্তি এবং স্মৃতিস্তম্ভগুলোর ওপর। গত সোমবার বেলজিয়ামের মন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের দাবির মুখে রাজা লিওপল্ডের একটি আবক্ষ মূর্তি সরিয়ে ফেলে।

বেলজিয়ান-কঙ্গোলিজ কবি এবং বেলজিয়ান নেটওয়ার্ক অব ব্ল্যাক লাইভের মুখপাত্র জোয়েল সামবি এনজেবা বলেন, “এই শহরের রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় যখন দেখি প্রতিটি কোনায় বর্ণবাদ এবং ঔপনিবেশিকতাকে মহিমান্বিত করা হচ্ছে, তখন মনে হয় আমি এবং আমার ইতিহাস সব মিথ্যা।“

কঙ্গো থেকে মানুষ নিয়ে এসে ব্রাসলসের একটি চিড়িয়াখানায় প্রদর্শনী করা হতো

আন্দোলনকারীদের প্রধান নজর ব্রাসেলসে রাজপ্রাসাদের মূল প্রবেশপথের বাইরে ঘোড়ার ওপর রাজা দ্বিতীয় লিওপল্ডের একটি মূর্তি। এটি সরিয়ে ফেলার জন্য নগর কর্তৃপক্ষের কাছে একটি আবেদনে এখন পর্যন্ত ৭৪হাজার মানুষ সই করেছেন।

“মূর্তিটি উৎপাটন করা হলে আমি সেদিন রাস্তায় নাচবো। আমার জীবনে এমন ঘটনা ঘটবে তা স্বপ্নেও ভাবিনি,“ বলছেন মিজ কায়ামবি। “

এ ঘটনা কঙ্গোর মানুষকে অনেক স্বস্তি দেবে, বিশেষ করে ঔপনিবেশিক শাসনামলে যাদের পরিবার হত্যা নির্যাতনের শিকার হয়েছে।“

তবে এই আইনজীবী মনে করেন, বেলজিয়াম থেকে রাজা লিওপল্ডের স্মৃতিচিহ্ন মুছে ফেলার বিষয়টি অতটা সহজ নয়, আর দ্রুত সেটি হবেও না।

বেলজিয়ামে রাজা লিওপল্ডের ১৩টি মূর্তি রয়েছে। এছাড়া অনেক রাস্তা, স্থাপনা এবং পার্ক তার নামে।

আফ্রিকা জাদুঘরের বাইরে এক ব্যক্তি রাজার মূর্তি নামিয়ে ফেলার বিপক্ষে কথা বললেন। তার কথা, “এগুলো আমাদের ইতিহাসের অংশ।“

যে রাজা এখনও নায়ক:
শুক্রবার বেলজিয়ামের বর্তমান রাজা ফিলিপের ছোট ভাই প্রিন্স লরেন্ট রাজা বলেন, রাজা দ্বিতীয় লিওপল্ড তার উপনিবেশে হত্যা-নির্যাতনের জন্য দায়ী ছিলেন না, “কারণ তিনি নিজে কখনই কঙ্গোতে যাননি।“

তবে বেলজিয়ামের রাজপ্রাসাদের পক্ষ থেকে এই বিতর্ক নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলা হয়নি।

দীর্ঘদিন ধরে বেলজিয়ামে রাজা লিওপল্ডকে দেখা হয় আধুনিক বেলজিয়াম রাষ্ট্রের অন্যতম একজন প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে। তাকে এমন একজন রাজা হিসাবে দেখা হয় যিনি ১৮৭০-৭১ সালে ফ্রান্স-প্র্রুশিয়ান যুদ্ধে বেলজিয়ামকে নিরপেক্ষ রেখেছিলেন।

দুহাজার দশ সালে সাবেক বেলজিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রী লুই মিশেল রাজা লিওপল্ডকে “বেলজিয়ামের মত ছোটো একটি দেশের উচ্চাভিলাষী নায়ক“ হিসাবে বর্ণনা করেন।

এ সপ্তাহে এক টিভি বিতর্কে ফ্রি ইউনিভার্সিটি অব ব্রাসেলসের সাবেক প্রেসিডেন্ট হারভে হাসকুইন বলেন, মধ্য আফ্রিকায় বেলজিয়ামের উপনিবেশবাদ ঐ অঞ্চলকে অনেক সুবিধা দিয়েছে। তার মতে, সেখানকার রাস্তা-ঘাট, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, শিক্ষার উন্নতিতে বেলজিয়ামের অনেক অবদান রয়েছে।

জবরদস্তি শ্রম ও নৃশংসতার ওপর দাঁড়ানো উপনিবেশ:
আঠারোশ পঁচাশি সালে অন্য ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক দেশগুলোর মধ্যে যখন পুরো আফ্রিকা নিয়ে ভাগাভাগি চলছিল, সেসময় রাজা লিওপল্ডের প্রধান স্লোগান ছিল, “সভ্যতা।“ অর্থাৎ আফ্রিকায় “সভ্যতার আলো“ নিয়ে যাবেন তিনি।

তিনি সেসময় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি আফ্রিকার সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়নে সম্ভাব্য সবকিছু করবেন।

তার কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বার্লিনে এক সম্মেলনে ইউরোপীয় নেতারা বেলজিয়ান রাজাকে আফ্রিকায় ২০ লাখ বর্গ কিলোমিটারের একটি জায়গা অনুমোদন করেন যেখানে তিনি ব্যক্তিগত উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করবেন।

রাজা তার উপনিবেশের নাম দেন কঙ্গো ফ্রি স্টেট। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই নির্যাতন আর নৃশংসতার পরিচয় দিতে শুরু করেন রাজা লিওপল্ড।

জোরপূর্বক শ্রম ব্যবহার করে রাবার চাষ, হাতির দাঁত এবং নানা খনিজ দ্রব্যের ব্যবসা শুরু করে দেন বেলজিয়ান রাজা।

নৃশংসতার নানা চিত্র:
কোনো ধরণের অবাধ্য হলেই এমনকি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে ফেলার বহু প্রমাণ রয়েছে। মানুষকে দাস বানিয়ে ফেলা নৈমিত্তিক ঘটনা ছিল।

শিশুদের জোর করে ধরে নিয়ে গিয়ে “শিশু কলোনিতে“ অবদ্ধ করে রেখে সেনা প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। এসব কলোনিতে ৫০ শতাংশ শিশুই শেষ পর্যন্ত মারা যেত।

এ ধরনের নির্যাতন, দুর্ভিক্ষ, রোগে-শোকে এক কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল বলে বলা হয়, যদিও অনেক ঐতিহাসিক এই সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক করেন।

রাজা লিওপল্ড নিজে কখনোই কঙ্গোতে পা রাখেননি, কিন্তু তার ঔপনিবেশিক শাসনের ফায়দা তিনি নিজে এবং বেলজিয়াম লুটেছে।

তার রাজপ্রসাদের আঙ্গিনায় তিনি আফ্রিকা চিড়িয়াখানা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যেখানে ২৭০ জন কঙ্গোলিজ নারী-পুরুষকে প্রদর্শনীর অংশ করা হয়েছিল।

খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকরা এবং ব্রিটিশ একজন সাংবাদিক এডমন্ড ডেন মোরেল প্রথম কঙ্গোতে রাজা লিওপল্ডের ঔপনিবেশিক প্রশাসনের ভয়াবহ নির্যাতনের নানা চিত্র ফাঁস করে দেন।

এতটাই দুর্নাম ছড়িয়ে পড়তে থাকে যে ১৯০৮ সাল নাগাদ তৎকালীন ইউরোপীয় অন্য ঔপনিবেশিক প্রভুরাও নাখোশ হয়ে পড়েন। তারপর বেলজিয়ামের সংসদ কঙ্গোতে তার ক্ষমতা কেড়ে নেয়।

উনশিশো আট সালে বেলজিয়াম সরকার কঙ্গোর ক্ষমতা গ্রহণ করে। স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৬০ সালে দেশটি স্বাধীন হয়।

গত বছর জাতিসংঘের একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ কঙ্গোতে ঔপনিবেশিক হত্যা-নির্যাতনের জন্য বেলজিয়াম রাষ্ট্রকে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানায়য়।

তবে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী চার্লস মাতিস তা প্রত্যাখ্যান করেন।

তাদের ঔপনিবেশিক ইতিহাস বেলজিয়ামে কখনই স্কুল-কলেজে পড়ানো হয়নি। তবে এ সপ্তাহে বেলজিয়ামের শিক্ষামন্ত্রী ঘোষণা করেন সামনের বছর থেকে মাধ্যমিক স্কুল স্তরে দেশের ঔপনিবেশিক ইতিহাস পড়ানো হবে।


Spread the love

Leave a Reply