ব্রিটেনে শিশুদের পড়াশুনায় এতো আনন্দ!

Spread the love

বাংলা সংলাপ ডেস্কঃ বাংলাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সাধারণত শিক্ষকদের ভয় পেয়েই শিশুরা অভ্যস্ত। বিদ্যালয়ে যাওয়া মানেই তোতো একটা কাজ। গেলেই মনটা ছটফট করে—কখন মিলবে ছুটি। কিন্তু যুক্তরাজ্যে এই চিত্র বলা চলে পুরোটাই বিপরীত। এখানে বিদ্যালয় কেবল শিশুদের পাঠশালা নয়, বরং শিশুদের বিনোদনের প্রাণকেন্দ্র। শিক্ষকেরাই এখানে শিশুদের আসল বন্ধু-সহযোগী।

লিভার্স সার্টিফিকেট বা বিদায়ী সনদ দেওয়া হয় শিক্ষার্থীদের।
লিভার্স সার্টিফিকেট বা বিদায়ী সনদ দেওয়া হয় শিক্ষার্থীদের।

পূর্ব লন্ডনের ডেগেনহ্যাম হিথওয়ে এলাকায় অবস্থিত ‘হান্টার্স হল প্রাইমারি স্কুল’। বৃহস্পতিবার এ বিদ্যালয়ে ছিল ‘লিভার্স সিরেমনি’। অর্থাৎ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে যারা উচ্চমাধ্যমিকে (সেকেন্ডারি স্কুল) যাবে, তাদের বিদায়ী অনুষ্ঠান। ৯০ জন বিদায়ী শিক্ষার্থী, তাদের অভিভাবক এবং বিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারী সবাই উপস্থিত এই অনুষ্ঠানে।

যুক্তরাজ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত। সপ্তম শ্রেণি থেকে শিক্ষার্থীরা উচ্চমাধ্যমিক শুরু করে। আর জিসিএসই (এসএসসি সমমান) পরীক্ষা দেওয়ার আগ পর্যন্ত এ দেশে পাস-ফেলের কোনো ব্যাপার নেই। বয়স অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের শ্রেণি নির্ধারিত হয়। বয়স ১১-তে পড়লেই সপ্তম শ্রেণিতে পড়তে হয় এখানে।

শ্রেণিশিক্ষকেরা শুভকামনা করে নানা বার্তা লিখে স্বাক্ষর দেন।
শ্রেণিশিক্ষকেরা শুভকামনা করে নানা বার্তা লিখে স্বাক্ষর দেন।

যেমন বিদায়ী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছিল বাংলাদেশি পরিবারের সন্তান আরন মাহমুদ হোসেন। তার বাবা মীর হোসেন আগে থেকেই যুক্তরাজ্যে ছিলেন। সেই সুবাদে মা আফরোজা হোসেনের সঙ্গে গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমায় আরন। তার বয়স তখন নয় বছর চলছিল। ২০১৭ সালের মার্চে শিক্ষাবর্ষের মধ্যম ভাগে তাকে এই বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি নেওয়া হয়। ছয় মাস পর সেপ্টেম্বরেই সে উঠে যায় ষষ্ঠ শ্রেণিতে। আর আসছে সেপ্টেম্বর থেকে সে উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে, অর্থাৎ সপ্তম শ্রেণিতে যাচ্ছে। অথচ চট্টগ্রামের একটি বিদ্যালয় থেকে মাত্র তৃতীয় শ্রেণি শেষ করে যুক্তরাজ্যে আসে আরন।

বাংলাদেশি পরিবারের সন্তান আরন মাহমুদের উদ্দেশ্যে অটোগ্রাফ বুকে বার্তা লেখে তার সহপাঠীরা।
বাংলাদেশি পরিবারের সন্তান আরন মাহমুদের উদ্দেশ্যে অটোগ্রাফ বুকে বার্তা লেখে তার সহপাঠীরা।

আফরোজা হোসেন ছেলে আরনকে নিয়ে বিদায়ী অনুষ্ঠানে যান। সামনে সারি হয়ে দাঁড়াল শিক্ষার্থীরা। একজন শিক্ষক ঘোষণা করলেন বিদায়ী দিনের আনুষ্ঠানিকতা। বিদায়ী শিক্ষার্থীদের একে একে মঞ্চে ডেকে বিদায়ী সনদ দেওয়া হলো। যেখানে কোনো ফলাফলের কথা বলা নেই। এরপর শিক্ষার্থীদের সবাইকে একটি করে ‘লিভার্স অটোগ্রাফ বুক’ দেওয়া হলো। এতে প্রতি পাতায় একজন করে বিদায়ী শিক্ষার্থীর ছবি দেওয়া। আছে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীর নাম ও সহপাঠীর জন্য বার্তা লেখার স্থান। বিদায়ী শিক্ষার্থীরা প্রত্যেকে একে অপরের কাছ থেকে বিদায়ী বার্তা (অটোগ্রাফ) লিখিয়ে নিল।

তারপর বিদায়ী শিক্ষার্থীদের পরিবেশনায় অনুষ্ঠিত হলো ছোট ছোট তিনটি নাটিকা। যেখানে তারা বন্ধুত্ব, দয়ালু মনোভাব এবং মানুষকে সম্মানের বিষয়টি তুলে ধরল। মাত্র বছরখানেক আগে যুক্তরাজ্যে যাওয়া আরনও অভিনয় করল তাতে।

তারপর বিদায়ী শিক্ষার্থীদের সমস্বরে গান। সবাই একসঙ্গে গাইল ‘উই আর অল ফ্রেন্ড’ (আমরা সবাই বন্ধু) শিরোনামের একটি গান। সেই গানে করতালি দিয়ে হালকা নাচও করল তারা। মঞ্চের ওপরের বড় পর্দায় দেখানো হলো বিদায়ী শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ‘স্কুল ট্রিপ’-এর স্থিরচিত্র। তাতে দেখা গেল, শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সময় নদীভ্রমণে গিয়েছে, গিয়েছে জাদুঘরে বা সাঁতার কাটতে।

সবশেষে শিক্ষার্থীদের উপহার হিসেবে দেওয়া হলো খাতা, পেনসিল, রাবার, ব্যাগসহ উচ্চমাধ্যমিকের জন্য প্রয়োজনীয় নানা সামগ্রী। ছিল ‘ট্রাভেল কার্ড’ রাখার ওয়ালেটও। কারণ, উচ্চমাধ্যমিকে এসব শিশু নিজে নিজেই পাবলিক ট্রান্সপোর্টে করে বিদ্যালয়ে যাতায়াত করবে। বিদায়ী শিক্ষার্থীদের সবাইকে একটি করে টি-শার্ট দেওয়া হলো। সাদা সুতি কাপড়ের ওই টি-শার্টের পেছনে বড় করে লাল রঙে ‘লিভার্স এইটিন’ (আঠারো) লেখা। ‘এইটিন’ হলো তাদের বিদায়ের সন। আর ওই ‘এইটিন’-এর মধ্যেই বিদায়ী সব শিক্ষার্থীর নাম লেখা রয়েছে।

শিক্ষার্থীরা তাদের শ্রেণিশিক্ষকদের জন্য নানা উপহার নিয়ে যায়। যেমন: আরন মাহমুদ তার তিনজন শিক্ষককে মগ, কার্ড ও চকলেট দেয়। এসব শিক্ষক তখন তাদের ‘লিভার্স সার্টিফিকেট’-এর পেছনে শুভকামনা করে নানা বার্তা লিখে স্বাক্ষর দেন।

চূড়ান্ত পর্বে উচ্চমাধ্যমিকে পাড়ি দেওয়া নিয়ে উদ্দীপনামূলক এক বক্তব্য দিলেন প্রধান শিক্ষক সেলিনা ফ্রেজার। ভালো, দয়ালু ও দক্ষ মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠার প্রয়োজনের কথা বললেন তিনি। সুন্দর জীবন গড়ার জন্য নানা উপদেশও দিলেন। শুভকামনা করলেন তাদের নতুন বিদ্যালয় জীবনের।

এরপর বিদ্যালয় ছেড়ে বেরিয়ে আসার সময় সব শিক্ষার্থীর চোখ জলে টলমল। প্রিয় স্কুল প্রাঙ্গণ আর কাছের বন্ধুদের ছেড়ে যাওয়ার বুক ফাটার যন্ত্রণা তাদের চোখে-মুখে।

কথা হলো আরন মাহমুদের সঙ্গে। সে বলল, বাংলাদেশের চেয়ে এখানকার বিদ্যালয় বেশ মজার। বিদ্যালয়ে বেশির ভাগ সময় কেবল খেলাধুলা। নাচের দলেও ছিল সে। তাদের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে নিয়ে গেছেন শিক্ষকেরা। বিদ্যালয়ে সহপাঠীদের সঙ্গে সারা রাত থেকে শিশুতোষ সিনেমাও দেখেছে একাধিকবার। বিদায়ী অনুষ্ঠানের আগের দিনও তাদের স্থানীয় একটি ‘টেম্পোলিন পার্কে’ ঘুরতে নেওয়া হয়।

আরন মাহমুদের মা আফরোজা হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বয়স অনুযায়ী আরনকে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি নেওয়া হলেও তার ইংরেজি ভাষা এবং গণিতে অনেক দুর্বলতা ছিল। শ্রেণিশিক্ষকেরাই নিজ থেকে এসব দুর্বলতা অনুসন্ধান করে তাকে বিশেষ সহায়তা দেন। বিদ্যালয়েই সব পড়া শেষ হয়ে যায় বলে জানান তিনি। আর বিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে গিয়ে আরন নিজেই বাড়ির কাজগুলো করে ফেলত। – সৌজন্যে প্রথম আলো


Spread the love

Leave a Reply