একজন ‘বুদ্ধিমান বোকা’ ও তার সফলতার উপাখ্যান

Spread the love

মঈনুল হক মঈন
সিলেট শহরতলীর এক নিভৃত পল্লীতে শিক্ষিত মাতা-পিতার প্রথম সন্তান হিসেবে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হওয়ার দু’বছর পূর্বে আমার জন্ম। আমার শৈশব-কৈশোর কাটে অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে। কেননা বৃটেন প্রবাসী চাচার সাথে ছিল আমাদের যৌথ পরিবার। অত্যন্ত সৌখিন ব্যক্তিত্ব আমার পিতা ছিলেন ঢাকার খামারবাড়ী থেকে প্রকাশিত মাসিক ‘কৃষিকথা’র নিয়মিত গ্রাহক এবং উত্তরাধিকারসূত্রে বেশ ভূসম্পত্তি ও বিরাট বসতবাড়ির মালিক। বিভিন্ন ফলফলাদির গাছে সুশোভিত বাড়িতে ছিল শানবাধানো ঘাটসহ দু’টি পুকুর। বিকেলে ঘাটে বসলে দেখা যেতো বিভিন্ন রঙ-বেরঙের মাছের দলবেঁধে লাফালাফি। আশির দশকে যৌথপরিবার ভেঙে গেলে বাবা আর্থিকভাবে সামান্য কষ্ট পেলেও মানসিকভাবে প্রচণ্ড হুচট খান। তবে মায়ের পরিচর্যায় বাবা আস্তে আস্তে মানসিকভাবে সুস্থ হয়ে উঠেন এবং ১৯৮৪ সনে আমি দাখিল পাশ করার পর পড়ালেখা করার সাথে সাথে বাবাকে সংসারের চাপ থেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করছিলাম। আবার বিশেষ বিশেষ সময়ে বৃটেন প্রবাসী শ্রদ্ধেয় ছোট মামার কাছে চিঠি লিখতাম। মামা আমাকে অত্যন্ত øেহ করতেন বিধায় আমার চিঠিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন।
একদা মায়ের কাছে খবর আসে যে, বৃটেন প্রবাসী তাঁর ছোট ভাই আমাদের পরিবার ও আমাদের বড় খালার পরিবারকে সাবলম্বী করে তুলতে এবং আরো কিছু কাজ করতে আমার বড় মামার কাছে দশ লক্ষ টাকা পাঠিয়েছেন। কয়েকদিন পরে বড় মামা আমাদের বড় খালার প্রথম পুত্রকে সিলেট শহরের হকার্স মার্কেটে একটি তৈরি পোশাকের ব্যবসার বন্দোবস্ত করে দেন। এমনি সময় আমার সহোদর ১৯৮৭ সনের মাধ্যমিক পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার পর আমার শ্রদ্ধেয়া মা জননী স্বীয় ভাইয়ের কাছে একটি বিশেষ আবেদন নিয়ে হাজির হন। আমার বড় মামা ছিলেন শহরের তখনকার জমজমাট ব্যবসায়িক এলাকা কাজিরবাজার পিঁয়াজপট্টির নামকরা ব্যবসায়ী। বড় বোনের ছেলেকে যেভাবে লক্ষাধিক টাকা ইনভেস্ট করে ব্যবসার বন্দোবস্ত করে দিয়েছেন, নিজ পুত্রকেও যেন একটি ব্যবসার বন্দোবস্ত করে দেয়া হয়; এমন অযৌক্তিক দাবি করার মতো সাহস আমার মায়ের ছিল না। মায়ের দাবি ছিল, মামা যেন আমার ছোট ভাইকে তাঁর দোকানের এক কোণে অন্ততঃ একটি পান-সিগারেটের দোকান নিয়ে বসার ব্যবস্থা করে দেন। আমার মায়ের কথাটি শুনে মামা হা-হা-হা করে হেঁসে উঠেন। অত্যন্ত তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যভরে মাকে বলেন-“তোমাকে ইতিপূর্বে অনেক বুদ্ধিমতি ভাবতাম, অথচ আজ তুমি এমন বেয়াক্কেলের মত প্রস্তাব করলে! তোমার কি জানা নেই যে ব্যবসা করতে হলে সর্বপ্রথম জ্ঞান-বুদ্ধির দরকার হয়? তোমার এই বোকা পুত্রকে নিয়ে তুমি এত বড় স্বপ্ন কেমনে দেখছ? সব কিছুরই একটি সীমা আছে। তার চৌদ্দ-পুরুষের কেউ কি কোনো দিন ব্যবসা করেছে?”
অবশ্য পরে বড় মামা একটু ভদ্র ভাষায় আমার মাকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, আমার খালাতো ভাইয়ের জন্ম হয়েছে শহরে আর আমার ভাইয়ের জন্ম হয়েছে গ্রামে। তাই দু’জনের যোগ্যতা ভিন্ন। শহরের ছেলে যে কাজের উপযোগী, গ্রামের ছেলে সে কাজের উপযোগী হতে পারে না। শহরের একটি ছেলেকে দিয়ে কৃষি কাজ করানো যেমন অসম্ভব, ঠিক সেভাবেই গ্রামের ছেলেকে দিয়েও ব্যবসা করানো অসম্ভব। অজোপাড়াগায়ে জন্ম নেয়া বোকা ও নিষ্কর্মা একটি ছেলেকে ব্যবসায়ী বানানো অলিক কল্পনা বৈ কিছু নয়।
আমার মা জননী তখন হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন। আমি ছিলাম তখন মায়ের পাশে বসা। মায়ের চোখে পানি দেখে আমার চোখও অশ্র“সিক্ত হয়ে উঠে। তবে মায়ের জোরে জোরে কান্না দেখে একটু পর মামীজান এসে মামাকে দোষারূপ করায় মামা এক সময় ‘সরি’ বলতে বাধ্য হন। অতঃপর মামা আমার মাকে সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত জ্ঞান-বুদ্ধি খরচ করে বিকল্প কোন চিন্তা-ভাবনার পরামর্শ দেন।
নিরাশ হয়ে ভাইয়ের কাছ থেকে ফিরে এসে মা পুরোপুরি নীরব হয়ে যান। ইতঃপূর্বে শুধু মানসিকভাবে দুর্বল হলেও এক পর্যায়ে এসে মা শারীরিকভাবেও অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েন। আমি তখন সিলেট সরকারী আলিয়া মাদ্রাসার কামিল শ্রেণিতে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছিলাম এবং সিলেট সরকারী কলেজে বিএ পাস কোর্সে ভর্তি হয়েছিলাম। মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য সিলেট সরকারী আলিয়া মাদ্রাসায় ‘কাদেরিয়া বৃত্তি’ নামে একটি বৃত্তি ফান্ড ছিল। আল্লাহর রহমতে আমি আলিম শ্রেণি থেকে কামিল শ্রেণি পর্যন্ত প্রতি বছর এই বৃত্তি লাভে সক্ষম হই। ১৯৮৮ সনে উচ্চ মাধ্যমিক সমমানের ফাজিল পরীক্ষায় অনেক নিুমানের রেজাল্ট করেও আমার অনেক সহপাঠি দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে ভর্তি হয়েছিল, আমি অনেক ভাল রেজাল্ট করেও বিষয়টা নিয়ে ভাবতেও পারিনি। কেননা সিলেটের বাইরে গিয়ে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষা অর্জন করতে গেলে আমার ছোট ভাই-বোনেরা একেবারে অশিক্ষিত থেকে যাবে। উল্লেখ্য, তখন সিলেটে কোন বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। পরিবারের অর্থ চাহিদা আমাকে পীড়া দিচ্ছিল বিধায় নিরূপায় হয়ে বৃটেন প্রবাসী মামার পরামর্শ চাই।
সময়ের পরিক্রমায় ১৯৮৯ সনে মা বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন। ডাক্তারের পরামর্শে মাকে এম. এ. জি. ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করি। পায়ে হেটে ওয়ার্ডে ঢুকতে পারলেও বিভিন্ন ইনজেকশন পুশ করার পর মা সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন। মায়ের সংজ্ঞাহীন অবস্থায় আমাদের এক মৃত ভাই জন্মগ্রহণ করে। প্রবাসী মামা আমার মায়ের চিকিৎসার জন্য টাকা পাঠান এবং আমাকে মধ্যপ্রাচ্য যাওয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করতে পরামর্শ দেন। আমি নিজে গেলে মধ্যপ্রাচ্য যাওয়ার যাবতীয় খরচ তিনি বহন করবেন বলেও জানান। তবে আমার ছোট ভাই হলে তিনি খরচ বহন করবেন না। কারণ বড় মামার কাছ থেকে তিনি জানতে পেরেছেন যে, আমার এ ভাইটি একেবারে বোকা। তার মত একটি বোকা ছেলের পেছনে তিনি লক্ষ টাকা খরচ করতে পারেন না।
প্রায় দেড় মাস হাসপাতালের ওয়ার্ডে চিকিৎসা শেষে সংজ্ঞাহীন মাকে কেবিনে নিয়ে আসি। কেবিনে এক সপ্তাহ অবস্থানের পর ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৮৯ রাতের প্রথমভাগে মা হঠাৎ করে কথা বলা শুরু করে দেন। আমরা তিন ভাইবোন অনেকটা হতভম্ব হয়ে ওয়ার্ডে অবস্থানরত ডাক্তারদের কেবিনে ডেকে নিয়ে আসি। বিশেষ করে ডাক্তার পারভিন ও ডাক্তার কামরুলের অসহায়ের মত কথাগুলো আজ বেশি মনে পড়ছে। ডাক্তাররা চলে যাওয়ার পর মা আমার ছোট ভাইকে ডেকে এমন কিছু উপদেশ দিচ্ছিলেন, যা শুনে আমরা শুধুই হাসছিলাম। কথাগুলো ছিল তখনকার সময়ের জন্য বড়ই অযৌক্তিক ও হাস্যকর। পরদিন ১লা অক্টোবর ১৯৮৯ সকালে মা আমাদের ছেড়ে না-ফেরার দেশে চলে যান।
অতঃপর প্রবাসী মামার পয়সায় কেনা ভিসা নিয়ে ১৯৯০ সনের এপ্রিলে আমার ‘কামিল’ পরীক্ষার কয়েকদিন পূর্বে আমি কাতার চলে যাই। বেশ কয়েক মাস অনেক চড়াই-ওতরাই পেরিয়ে কাতারের পুলিশ বিভাগে চাকরী লাভ করি। উল্লেখ্য, কাতারের পুলিশ বিভাগে বিদেশি লোক নিয়োগের এটিই ছিল সর্বশেষ সুযোগ। অবশ্য অপ্রশিক্ষিত বিভাগে এখনও মাঝে-মধ্যে বিদেশী লোক নিয়ে থাকে। এরপর প্রশিক্ষিত বিভাগে সেখানকার স্থানীয় ছাড়া কোন বিদেশি নিয়োগ লাভ করতে পারেনি।
অর্থসঙ্কটে নিজে লেখাপড়া করতে না পারার কষ্টটি ভাইবোনদের লেখাপড়া করিয়ে ভোলার পরিকল্পনা করছিলাম। এমতাবস্থায় একদিন ডিউটিতে রওয়ানা হওয়ার পূর্বক্ষণে ভাইয়ের একটি চিঠি আমার হাতে এসে পৌঁছে। চিঠিটি সাইডব্যাগে ঢুকিয়ে অফিসে যাই এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি রিসিভ করে অফিসের গাড়িতে চড়ে ডিউটির নির্ধারিত স্থানে পৌঁছি। অতঃপর চারজন সহকর্মীসহ একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে একজন সিকিউরিটি পুলিশ হিসেবে ডিউটি শুরু করি। সামান্য বিরতি নিয়ে চিঠিটি খুলে পড়া শুরু করি।
ভাইটি লিখেছে-শহরের কুমারপাড়ায় একটি লজিংয়ে থাকাবস্থায় সে বিকালে টিউশনি করে প্রচুর ক্লান্ত অবস্থায় এক রাতে একটি প্রোগ্রামে গিয়েছিল মেডিকেল কলেজ অডিটোরিয়ামে। ফেরার পথে হেটে কুমারপাড়া পৌঁছা ছিল তার জন্য বড়ই কষ্টকর। পকেটে টাকাও ছিল না যে রিক্সা করে ফিরবে। তাই সে জনৈক সচ্ছল সহপাঠী এক ছাত্রনেতার কাছে দশটি টাকা ঋণ চেয়েছিল; যিনি তাকে অনুষ্ঠানের দাওয়াত দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি না দেয়ায় শেষ পর্যন্ত তাকে হেঁটেই লজিংয়ে ফিরতে হয়েছিল।
আমি তখন মোটামুটি ভালো বেতনে কর্মরত। আর আমার ভাইটি রিক্সা ভাড়ার অভাবে এত কষ্ট করছে! কথাটি মেনে নিতে পারছিলাম না। তাই চোখ দু’টি অশ্র“সিক্ত হয়ে উঠে। আমার এমন অবস্থা এক ইয়েমেনি সহকর্মী দেখে আমাকে জড়িয়ে ধরে। ইতঃপূর্বে আমি নীরবে কাঁদলেও তার জড়িয়ে ধরার পর আমি হাউমাউ করে কেঁদে উঠি। আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছি মর্মে একটি ম্যাসেজ অন্য এক সহকর্মী সাথে সাথেই কর্তৃপক্ষকে জানায়। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই অফিস থেকে আমার জন্য একটি অ্যাম্বুলেন্স এবং একটি জীপে করে আমার বদলি ডিউটির জন্য অন্য এক সহকর্মী চলে আসে। আমার কাছে রক্ষিত সরকারী অস্ত্রপাতিসহ যাবতীয় সরঞ্জামাদি রিসিভ করার পর আমাকে অ্যাম্বুলেন্সে ওঠানো নয়। পুলিশ হাসপাতালের প্রবেশ পথেই একজন ডাক্তার সাহেবকে দেখতে পাই। আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে তিনি আমার সমস্যার কথা জানতে চান। ‘আমার কিছু হয়নি, আমাকে শুধু একটু কাঁদতে দিন’ বলার পর তাঁরা আমাকে একটি কক্ষে এনে শুইয়ে দেয়।
লেখাপড়ার প্রয়োজনে পরিবারের সবাইকে শহরে বাসা ভাড়া করে নিয়ে আসতে ভাইকে নির্দেশ দিই। গ্রাম থেকে শহরে নিয়ে আসার মতো ফার্নিচার তখন আমাদের পরিবারে ছিল না। কেননা ফার্নিচারগুলোর অধিকাংশই ছিল আমার দাদার আমলের বানানো, বিরাট বিরাট সাইজের। তাই সহকর্মী দু’জন বন্ধুর কাছ থেকে কিছু কর্জেহাসানা নিয়ে আমার বেতনসহ একটু মোটা অংকের টাকা ভাইয়ের কাছে পাঠাই। তারপর পরিবারের সবাই শহরে চলে আসেন।
একদা রাগ করে লেখা আমার একটি চিঠির জবাবে ভাই লিখেছিল-
“… শপথ করে আপনাকে বলতে পারি, আমি আমার ভাইবোনদেরকে এমনভাবে গড়ে তুলবো, যাদের নিয়ে আমরা গর্ববোধ করতে পারি। এটা আমার প্রতিশ্র“তি। কিন্তু ভাই অর্থের প্রয়োজন। তাতো আপনাকেই যোগাতে হবে। তবে আমার উপর রাগ করে ভাই এ সোনার সংসার ধ্বংস করে দেবেন না। এ সাধ স্বপ্ন ধসিয়ে দেবেন না। আমি না হয় সারা জীবন মজুরি করে খেলাম। আপনাদের কাজ-কর্মই করে না হয় খাব, তবুও ওদের উজ্জ্বল জীবনের পথে আপনি সহায় হোন। আমি তাদের উজ্জ্বল জীবন আপনার কাছে ভিক্ষা চাচ্ছি। আপনি টাকা বন্ধ করে দিলে আব্বাই সবচেয়ে দুঃখ পাবেন ও কষ্ট ভোগ করবেন। কিন্তু সাথে সাথে ওদেরও জীবনে অন্ধকার নেমে আসবে। …” উল্লেখ্য-ভাইয়ের লেখা তখনকার চিঠিগুলো আজও সযতনে সংরক্ষণ করছি; অলস ক্ষণে ওগুলো উল্টেপাল্টে দেখি।
কিছুদিন পর আমার পিতার লেখা একটি চিঠি পাই। নিুমানের লেবার ভিসায় হলেও আমার ভাইকে কাতার নিয়ে যাওয়ার জন্য বাবা আমাকে অনুরোধ করেছেন। আব্বার মতে-যুবক ছেলে বেকার বসে বসে খাচ্ছে, এটাতো কোনো পিতার কাছে ভালো লাগার বিষয় নয়। চিঠিতে তিনি আমাকে ভাইয়ের জ্ঞানের স্বল্পতার কথাটিও স্মরণ করিয়ে দেন। জবাবে আমি বাবাকে শান্তনা দিয়ে ভাইকে নিয়ে বেশি টেনশন না করার জন্য অনুরোধ করি।
কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় খরচপাতি ভাইকে পাঠিয়ে দেই। নিজেও চাকরির পাশাপাশি দোহা শহরের একটি কম্পিউটার ফার্মে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলাম। এদিকে দেশে প্রশিক্ষণ নিয়ে এক সময় ভাই সিলেটের একটি প্রিন্টিং প্রেসে একজন কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে যোগ দেয়। মাস দু’য়েক পর ভাইয়ের চাকরি চলে যাওয়ার খবর পেয়ে মনে প্রচণ্ড আঘাত পাই। তাই আর চাকরি নয়, দ্রুত ব্যবসার প্রস্তুতি নিতে ভাইকে নির্দেশ দিয়ে ১৯৯৪ সনে দেশে চলে আসি।
দেশে ফেরার সপ্তাহ দু’য়েকের মধ্যেই দু’টি পিসি ও একটি লেজার প্রিন্টার নিয়ে জিন্দাবাজারে মুদ্রণ ব্যবসা শুরু করি। এরপর থেকে আর পেছনে ফিরে তাঁকাতে হয়নি। সকাল ৯টা থেকে রাত ২/৩টা পর্যন্ত অনবরত আমরা দুই ভাই কাজ করতাম। যে ছাপার কাজগুলো আমাদের দায়িত্বে সে কাজগুলো একটি কম্পিউটারে আমার ভাই করত, আর আমি সাধারণত ছাপা হবে না বা শুধুমাত্র ট্রেসিং প্রিন্ট হবে-এমন কাজগুলো করতাম।
বিয়ের কার্ডের ট্রেসিং প্রিন্টের নিয়মিত কিছু কাস্টমার আমাদের ছিল। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হলো আইডিয়্যাল প্রোডাক্টস। আমরা খুচরা প্রতি পেজ তখন একশত টাকা করে নিলেও আইডিয়ালের প্রতিদিন পঞ্চাশ পেজেরও অধিক কার্ড থাকায় প্রতি পেজ আশি টাকা করে নিতাম। আইডিয়্যাল প্রোডাক্টস ছাড়াও কয়েকটি বিয়ের কার্ডের দোকান নিয়মিত ৮/১০ পেজ করে ট্রেসিং প্রিন্ট নিত। তবে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল হোসেইন এন্ড সন্স। তারা প্রতিদিন ২০/২২টি পেজ ট্রেসিং প্রিন্ট নিত। উল্লেখ্য, বিয়ের কার্ডে আমাদের তেমন সময় ব্যয় করতে হতো না। কেননা কার্ডের ছিল নির্দিষ্ট কয়েকটি সাইজ। সাইজ মিলিয়ে পুরাতন কার্ড বের করে শুধু বর-কনের নামসহ সামান্য কয়েকটি বাক্য পরিবর্তন করে ট্রেসিং-এ প্রিন্ট দিয়ে দিতাম। এ জন্য প্রতিদিন শতাধিক বিয়ের কার্ডের ট্রেসিং প্রিন্ট দিতে বড় ধরনের বেগ পেতে হতো না আমাকে। আর ২/৩ পেজ করে খুচরা কম্পিউটার কম্পোজের কাস্টমাররা লাইন ধরেই থাকতেন। ছাপার জন্য রিসিভ করা কাজ শেষ হয়ে গেলে বা না থাকলে আমার ভাই এ সব খুচরা কম্পোজগুলোতে আমাকে সহযোগিতা করত।
বাবাসহ আত্মীয়-স্বজন সবার কাছে আমার ভাই বোকা হলেও আমার দৃষ্টিতে সে ছিল অত্যন্ত বুদ্ধিমান। সাধারণত ছাপার কাজ লবিং-এ দোকানের বাইরে সে বেশি সময় ব্যস্ত থাকত আর আমি তার পরামর্শকে প্রাধান্য দিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছিলাম।
এক সময় কুদরত উল্লাহ মার্কেটের তদানীন্তন পুস্তক-ব্যবসায়ী আদর্শ লাইব্রেরির স্বত্বাধিকারী মিলন ভাইয়ের একটি আরবি বইয়ের কাজ রিসিভ করলেও ব্যস্ততার কারণে শুরুই করতে পারছিলাম না। কেননা শতাধিক পেজ বিয়ের কার্ডের ট্রেসিং প্রিন্ট প্রতিদিন আমাকে দিতে হতো। কাজ শেষে প্রায় প্রতিদিনই ঘড়িতে তাকিয়ে দেখতাম রাত ২টা পেরিয়ে গেছে। কার্ডের বাইরে অন্য কোনও কাজ থাকলে ফজরের আজানও হয়ে যেত। নতুন করে উল্লেখিত বইয়ের কাজ শুরু করার মতো মানসিকতা তখন আর থাকত না। আর কাজটি আরবি হওয়ায় ভাইও আমাকে কোন সহযোগিতা করতে পারছিল না।
একদিন মিলন ভাই এসে প্রচণ্ড রেগে যান। তাই তাঁকে কথা দিই-এখন থেকে বইটি প্রিন্ট দেয়ার পূর্ব পর্যন্ত আর খুচরা কোনো কাজ করব না এবং ঘুমাতেও যাব না। সে সময় থেকে নিয়ে একাধারে পুরো ৩০ ঘণ্টা কাজ করে ফরমেটিংসহ পুরো বইটির একটি প্রিন্ট কপি নিয়ে যখন রাতে মিলন ভাইয়ের লাইব্রেরিতে যাই, তখন আমার শরীরে আর কোনো চেতনা ছিল না। অজ্ঞান হয়ে চেয়ার উল্টে নিচে পড়ে যাই। লাইব্রেরী থেকে ফোন যায় আমাদের প্রতিষ্ঠানে। বর্তমানে লন্ডন প্রবাসী আলহাজ্ব মাওলানা আতাউর রহমান সাহেবের কাজ চলছিল তখন আমাদের কম্পিউটারে। তিনি সাথে সাথেই স্বীয় মোটর সাইকেল নিয়ে ছুটে আসেন আমাকে নিয়ে যেতে।
প্রতিষ্ঠান চালুর প্রায় বছর পাঁচেক পর এক কাস্টমার এসে আমাকে ডাকছে ‘ম্যানেজার সাহেব’ বলে। আমার পাশে বসা আমার ভাইটি চেয়ে চেয়ে দেখলেও ভাইয়ের ভজনফ্রেন্ড ফজলুররহমান বাবুল প্রতিবাদ করে বললেন, তিনি হলেন ‘মালিকের ভাই’।
ইতোপূর্বে কেনা হয়েছে অফসেট প্রিন্টিং মেশিন। পর্যায়ক্রমে এসেছে কয়েক ডজন স্টাফ। জানতে পারলাম-স্টাফরা জানে আমি হলাম প্রেসের ম্যানেজার। বিভিন্ন মাধ্যম থেকে জানতে পারছিলাম, আমার ভাই নাকি একান্ত দয়াপরবশ হয়ে আমার এবং আমার স্ত্রী-সন্তানের ভরণপোষণ করছে। আমার যে যোগ্যতা আছে বা একজন অপারেটর হিসেবে যে কাজ করছি, তার পাওনা হতে পারে সর্বোচ্চ হাজার তিনেক টাকা। আর ভাইয়ের সংসারে আমি স্ত্রী-সন্তানসহ তা থেকে অন্তত দ্বিগুণ খরচ করি।
সে সময় আমার আর পেছনে ফিরে তাঁকানোর সময় ছিল না। পরবর্তিতে ভাইয়ের হাতে অত্যাধুনিক মোবাইল ফোন আসলেও আমাকে ল্যান্ড ফোনে কথা বলতে হলে ভাইয়ের কাছ থেকে চাবি চেয়ে নিতে হয়। ভাই যখন লাখ লাখ টাকা নিজ ইচ্ছামাফিক খরচ করছে, তখন নিজের পকেট খরচের একশটি টাকাও কারণ দর্শিয়ে তার কাছ থেকে চেয়ে নিতে হয়। নতুন করে আরেকটি প্রতিষ্ঠান উদ্বোধন করার মত পুঁজির সংস্থান করার কোন সম্ভাবনা দেখছিলাম না, আবার এভাবে পেটেভাতে ভাইয়ের অধীনে কাজ করাও আর মানানসই মনে হচ্ছিল না। আমার শিশু সন্তানকে এক প্যাকেট বিস্কুট কিনে দিতে হলে ছোট ভাইয়ের কাছে গিয়ে আবদার করতে হয়। তাই কিছুটা হলেও হতাশা আমাকে গ্রাস করে। এক পর্যায়ে বড় মামাকে আমার হতাশার কথা জানাই। তিনি বাসায় এসে আমার ভাইয়ের কাছে বিষয়টা উপস্থাপন করেন।
নিজ ভাই হওয়ার কারণে মাসিক হাজার তিনেক টাকা বেতনের উপযোগী একজন অপারেটরের পেছনে দ্বিগুণ পরিমাণ টাকা খরচ করছে বলে ভাইটি মামার কাছে যৌক্তিকতা তুলে ধরে। অতঃপর অন্যায় একটি আবদার নিয়ে তার মত প্রতিষ্ঠিত একজন ব্যবসায়ীর কাছে যাওয়ার মত স্পর্ধা দেখানোর অপরাধে প্রকাশের অনুপযোগী পদ্ধতিতে অত্যন্ত নিকৃষ্টজনকভাবে অপমান করে মামাকে তাড়িয়ে দেয়। আমার ডাকে মামা আমার ভাইয়ের কাছে এসে অপমান হওয়ার পর আর ভাইয়ের সাথে সমঝোতার কোন সুযোগ আমার ছিল না; যদিও ভাই তখন আমাকে অত্যন্ত মোটা অংকের বেতনের প্রস্তাব দিয়েছিল।
মিলেনিয়াম সন ২০০০। আমার চরম দুর্দিনের বছর। সম্পূর্ণ খালি হাতে নিজের গড়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও সংসার থেকে বের হয়ে স্ত্রী ও দু’টি শিশু সন্তান নিয়ে অজানা গন্তব্যে বেরিয়ে পড়ি। উল্লেখ্য, ১৯৯৪ সনে দু’টি পিসি এবং একটি লেজার প্রিন্টার নিয়ে ব্যবসা শুরু করলেও ২০০০ সনে যখন প্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে পড়ি, তখন আমার ভাইয়ের একটি অত্যাধুনিক কম্পিউটার ল্যাব, তিনটি অফসেট প্রেসসহ প্রায় তিন ডজন কর্মচারী কর্মরত ছিল।
অনেক খোঁজাখুজি করে শহরের নবাব রোডে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী ফাতেমা মঞ্জিলে ‘কম ভাড়ার বাসা’য় উঠি। প্রথম পর্যায়ে বেঁচে থাকার জন্য আমার একটি চাকরির প্রয়োজন। সিলেট শহরের প্রেস মালিকরা চুক্তি করতে চায় যে, আমি কত বছর কাজ করব।
জনৈক প্রেস মালিকের কাছে চাকরির জন্য গেলে তিনি আমাকে আমার একজন মুরব্বি নিয়ে যেতে বলেন। আমি আমার ব্যবসায়ী বড় মামাকে নিয়ে তাঁর কাছে যাবার পথে রিক্সায় বসে মামা হিসেব করে দেখালেন যে, আমার এই ছোট্ট পরিবারটির একেবারে ন্যূনতম খরচ হবে বাসা ভাড়া দুই হাজার এবং অন্যান্য খরচ ন্যূনতম তিন হাজার। সর্বসাকুল্যে পাঁচ হাজার টাকা। শত চেষ্টা করলেও খরচ এ থেকে কমানো সম্ভব হবে না। আর শহরে একজন কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে চাকরী করে আমি তিন হাজারের উর্ধ্বেতো বেতন পাব না। মামা আরও স্মরণ করিয়ে দেন যে, আমার দাদার নির্মিত বাড়িতে ওঠারওতো কোন সুযোগ নেই; কেননা বাড়ীটি আমার ভাই ইতঃপূর্বে সম্পূর্ণ ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে। বাড়ির যাবতীয় আসবাবপত্র প্রতিবেশীরা লাকড়ী হিসেবে ব্যবহার করেছে। তাই গ্রামের কোন স্কুল-মাদ্রাসায় শিক্ষকতার চাকরী খোঁজার জন্য মামা আমাকে পরামর্শ দেন। তাহলে বাসা ভাড়া লাগবে না। গ্রামে যেখানে চাকরী হবে, সেখানের যে কারো বাড়িতে বিনা ভাড়ায় থাকা যাবে।
প্রেস মালিক মহোদয় মামাকে যথেষ্ট সমাদর করে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেন যে, পাঁচ বছরের চুক্তি করলে মাসিক বেতন হবে ১০ হাজার টাকা। উৎফুল্ল মুখে মামা প্রশ্ন করে বসেন, দশ বছরের চুক্তি করলে বেতন কত হতে পারে? প্রেস মালিক হেঁসে বললেন আরও দুই হাজার অর্থাৎ ১২ হাজার টাকা। তবে শর্ত হলো, চুক্তিপত্রে মামাকে স্বাক্ষী হিসেবে থাকতে হবে। কথাটি শুনে মামার চিন্তাক্লিষ্ট মুখটি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে; আনন্দে আমার হাত শক্ত করে ধরেন। ফেরার পথে মামা বার বার আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছিলেন আর বলছিলেন যে, আমাকে নিয়ে তিনি খুবই চিন্তিত ছিলেন। ভদ্রলোকের কথা শুনে তাঁর সেই দুশ্চিন্তা কেটে গেছে। মামা আরও বলেন, আমার এ চাকুরিটা আল্লাহর রহমতের ফল। তাই আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ে আমি যেন অন্তত তিন দিনের জন্য আল্লাহর রাস্তায় বের হই। তিন দিন আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ের পর যেন আমি এই প্রেসেই চাকুরিতে যোগ দেই। মামাকে তখন মনে করিয়ে দেই যে, এখানে আমার ডিউটি হচ্ছে ৮ ঘন্টা আর আমাদের প্রতিষ্ঠানে আমি কাজ করতাম ১৬ থেকে ২০ ঘন্টা পর্যন্ত।
আমি অবশ্য এই প্রেসে চুক্তিভিত্তিক চাকরীতে না ঢুকে চুক্তিবিহীন একটি চাকরির জন্য যখন হন্যে হয়ে ঘুরছি, তখন খবর পেলাম যে আমার ভাই সিলেট শহরের একটি অভিজাত আবাসিক এলাকায় বাসা করার জন্য বেশ বড় ধরনের একটি প্লট কিনেছে। এ প্লট কিনতে চেয়েছিলেন কয়েকজন বৃটেন প্রবাসী ও একজন আমেরিকা প্রবাসী, কিন্তু আমার ভাই সবাইকে টেক্কা দিয়ে প্লটটি হস্তগত করেছে। কষ্টের মাঝেও অত্যন্ত তৃপ্তি পেলাম। আমার শ্রম তো বৃথা যায়নি।
বেকার থাকার সপ্তাহ দু’য়েক পর সুরমা মার্কেটে একটি মাত্র পিসি দিয়ে গড়া একটি কম্পিউটার ফার্মের মালিক একান্ত দয়াপরবশ হয়ে তাঁর অপারেটরের গাইড কাম ম্যানেজার হিসেবে দৈনিক মজুরীতে অল্প বেতনে হলেও আমাকে একটি কাজ দেন। আমার ডিউটি সকাল সাড়ে নয়টা থেকে রাত দশটা। তবে একটি দিনও রাত ১১টার পূর্বে বের হতে পারিনি। দুপুরে খেতাম শুকনো দু’টি পরটা ও তিন গ্লাস পানি। প্রচণ্ড ক্ষিধা নিয়ে রাতে পায়ে হেটে সুরমা মার্কেট থেকে নবাব রোডে যেতে প্রচণ্ড শারীরিক কষ্ট হলেও মানসিক কোন কষ্ট হতো না। মাত্র একদিন ভাইয়ের পায়ে হাটার খবর জেনে প্রবাস জীবনে হাউমাউ করে কেঁদেছিলাম, আর আজ নিজে অভুক্ত অবস্থায় তা থেকেও বেশি পথ প্রতিদিন হেটে যাতায়াত করতে পারছি। চোখে তো এক ফোঁটাও পানি আসে না।
মাস চারেক চাকুরি করার পর ২০০০ সনের সেপ্টেম্বরে আমার এক বন্ধুর মধ্যস্থতায় জিন্দাবাজারের ঐতিহ্যবাহী একটি মার্কেটে আমি একটি অফিস ভাড়া নিতে সক্ষম হই এবং আরেক বন্ধুর জামানতে একটি কম্পিউটার ফার্ম থেকে একটি পিসি এবং একটি লেজার প্রিন্টার বাকি নিয়ে মুদ্রণ ব্যবসা শুরু করি। মহান রাব্বুল আলামীন ব্যবসায় প্রচুর বরকত দেন এবং আমি পর্যায়ক্রমে দেনা শোধের সাথে সাথে সুষ্ঠুভাবে নিজ সংসার ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালিয়ে নিচ্ছিলাম।
আসে ২০০৩ সন। আমার ভাই এখন আর বোকা ছেলে নয়; সিলেটের একজন উদীয়মান কোটিপতি ব্যবসায়ী। প্রায় দুই কোটি টাকা খরচ করে সিলেট শহরে বাড়ি বানিয়েছে। নিজ ব্যাংক একাউন্টের ব্যালেন্স শূন্য থাকাবস্থায় সে কোটি টাকা অংকের চেক কাটলেও সেটি পাশ হয়ে যায়। অর্থাৎ-তার কোটি টাকার সিসি লোন ব্যাংকে অনুমোদন করা আছে। এদিকে আমার বড় মামার মেয়েকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসছে। পাত্র ইউকের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। বিধিমোতাবেক মামারও প্রয়োজন পড়েছে কয়েকজন কোটিপতি আত্মীয়ের প্রদর্শনী। ১৯৮৭ সনে মাকে অপমান করার জন্য মামা আমার ভাইয়ের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলে ভাইটি অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণ হয়ে গিয়ে সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের সফল সমাপ্তি টানে।
২০০৩ থেকে ২০১৫। এই সুদীর্ঘ সময়ে আমাদের আত্মীয়-স্বজনদের ছোট বড় সব কাজ আমার ভাই ছাড়া সম্পন্ন হয় না। আত্মীয়-স্বজনদের সবাই আমার ভাইয়ের পরিচয়ে পরিচিত হতে চান। সবাই আমার ভাইকে নিয়ে গর্ববোধ করেন। কেননা আমার ভাইয়ের মতো প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ও উচ্চ পর্যায়ের বুদ্ধিমান কোনো লোক আমার আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে আজ পর্যন্ত দ্বিতীয় কেউ নেই।
বৃটেন প্রবাসী আমার ছোট মামা তাঁর পূর্ণ কর্মময় জীবনটাই ব্যয় করেছেন ভাই-ভাতিজা, ভাগনা-ভাগনী জাতীয় স্বজনের কল্যাণ চিন্তা করে। বৃদ্ধ বয়সে এসে হতাশা তাঁকে জেঁকে ধরেছে। তাঁর কোন সঞ্চয় নেই। মামার মানবিক কর্মকাণ্ডে অসন্তুষ্ট হয়ে তাঁর দুই পুত্র ও দুই কন্যা স্বীয় পছন্দে বিয়ে করে তাঁকে ছেড়ে চলে গেছে। হৃদয়বান এ মানুষটি সারা জীবন যে ভাইয়ের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন, একমাত্র সে ভাইটি ও তার পরিবারের সাথেও চলছে তাঁর পূর্ণ বিরোধ। এমনি অবস্থায় ২০১৪ সনের ফেব্র“য়ারিতে সহায়-সম্পত্তি রক্ষার ব্রত নিয়ে একা একাই দেশে আসেন। বিলেত থেকে তাঁর সাথে দেশে আসার মত বা অন্তত ফোন করে খোঁজ-খবর নেয়ার মত কেউ নেই।
মামার কল পেয়ে শহরতলীর বাড়িতে তাকে দেখতে যাই। দেশে ফিরে মামাজান পৈতৃক ভিটায় উঠেছেন। নিজের রান্না করে খাওয়া-দাওয়া করেন। সবার দৃষ্টিতে ‘পাগল’ হলেও আমি মামার মাঝে কোন পাগলামীর লক্ষণ তখন দেখতে পাইনি। সাধারণতঃ কোন পাগল রাস্তায় হাটলে অনেকেই ঢিল ছুড়ে, তবে মামার উপর আজ পর্যন্ত কেউ ঢিল ছুড়েনি; যদিও গ্রামে তিনি ‘জিতু পাগলা’ বলে বহুল পরিচিত। তিনি তাঁর কর্মময় জীবনের স্মৃতিচারণ করলেন। তাঁর জীবনের মূল সফলতা আপনজনদের দারিদ্র তিনি দূর করতে পেরেছেন। তবে নিজের জন্য সিলেট শহরে একটি বাড়ি করতে না পারার ব্যর্থতাও আছে তাঁর মনে।
দেশে ফিরেই মামাজান এলাকার এক ব্যক্তির সাথে জড়িয়ে পড়েন বিভিন্ন ফ্যাসাদে। ভূমিখেকো প্রতারক লোকটি মামার সম্পত্তি বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে হাতিয়ে নিচ্ছে। মামা একা একাই চেষ্টা করছিলেন সম্পত্তি উদ্ধারের, পাগল বলে কেউ তাঁর ধারে-কাছেও আসছেন না। সবাই তাঁর থেকে নিরাপদ দুরত্ব বজায় রেখে চলেন। সে প্রতারক লোকটি আমার উভয় মামা ও ব্যবসায়ী খালাতো ভাইয়ের উপর একেবারে অযৌক্তিক একটি মামলা দায়ের করে। তারা তিনজন নাকি রাতে লোকটিকে একা পেয়ে হত্যার চেষ্টা করেছিলেন। মামলা দায়েরের তারিখ হলো-১৬.০৩.২০১৪ এবং হত্যা প্রচেষ্টার তারিখ এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে ২৫.০৩.২০১৪ বলে। উল্লেখ্য, আমার উভয় মামা ও খালাতো ভাই কারোরই পূর্বতন আর্থিক ও সামাজিক অবস্থান এখন আর নেই। এক সময়কার জমজমাট ব্যবসায়ী এলাকা কাজির বাজার পিঁয়াজপট্টি এখন জনমানবহীন গোদাম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমার বড় মামা সফল ব্যক্তি, বৈবাহিক সূত্রে তাঁর তিন সন্তান এখন বৃটিশ নাগরিক; বাকী সন্তানরাও দেশে প্রতিষ্ঠার দ্বারপ্রান্তে।
মামলা দায়েরের পরদিনই জেলে ঢুকার ভয়ে ছোট মামা লন্ডন চলে যান। সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও হাস্যকর এ মামলার কারণে পুুলিশ আমার বড় মামা ও খালাতো ভাইকে তাড়া করছিল। তারা পুলিশের তাড়া খেয়ে শেষ ভরসাস্থল হিসেবে রাতে আমার ভাইয়ের বাসায় গিয়ে উঠেন। আমার ভাইয়ের মত শহরের উঁচুতলার একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীর বাসায় পুলিশ হানা দেবে না, এমন বিশ্বাস আছে তাঁদের। কেননা এ বাসায় পদধূলি দিয়েছেন শহরের বিশিষ্ট গুণিজনসহ অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। আমার ভাইটি মামা ও খালাতো ভাইকে উপযুক্ত সমাদর করে এবং পরদিন তার বাসায় ডেকে আনে একজন উচ্চপদস্ত জনপ্রতিনিধি ও একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে। তাঁদের পরামর্শ, দিকনির্দেশনা ও তদবিরে এখন পুলিশ আর তাঁদের তাড়া করছে না। উল্লেখ্য, আমার বড় মামা ও খালাতো ভাই আমার ভাইয়ের মধ্যস্থতায় বর্তমানে নিজ নিজ বাড়িতে ঘুমাতে পারছেন, তবে এ জন্য আমার ছোট মামাকে লন্ডন থেকে তদন্ত কর্মকর্তাকে নিয়মিত সালাম জানাতে হয়।
আজ থেকে বছর সাতেক পূর্বে নয়/দশ বছর বয়সের বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী কাজ প্রত্যাশী একটি ছেলেকে আমার কাছে নিয়ে আসা হয়। আমার কাছে আসার পর আমি তাকে অত্যন্ত বুদ্ধিমান হিসেবে আবিষ্কার করলাম। জানতে পারলাম, ইতিপূর্বে তার মা-বাবা পৃথক হয়ে যাওয়ায় সে সব কুল হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছিল। থাকা-খাওয়ার স্বাভাবিক কোন ব্যবস্থা না থাকায় টেনশন করে এক পর্যায়ে এসে হয়ে যায় বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। আমাকে মামা বলে সে ডাকে এবং দিনে আমার সাথে দোকানে আসা-যাওয়া করে, রাতে আমার সন্তানদের পড়ালেখার সময় সে তাদের সঙ্গ দেয়। জানতে পারলাম ছেলেটি তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে। পড়ালেখার প্রতি ছেলেটির আগ্রহ দেখে তাকে সিলেটের ভোলানন্দ নৈশ বিদ্যালয়ে ভর্তির পরামর্শ দিই। আমার কথামত স্কুলে ভর্তি হয়ে দোকানে আসা-যাওয়ার সাথে সাথে সে লেখাপড়াও চালিয়ে যেতে থাকে এবং সব সময় ক্লাসে প্রথম স্থান অর্জন করছিল। বিগত ২০১৪ সনের জেএসসি পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে পাশ করে। সে এখন আমার কম্পিউটার ফার্মের একজন গ্রাফিক্স ডিজাইনার এবং ভোলানন্দ নৈশ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। আমাদের মার্কেটে বেশ কয়েকটি প্রেসের অফিস রয়েছে। মার্কেটের কিছু কিছু প্রেস মালিক গ্রাফিক্স ডিজাইনার নিয়োগের সময় আমার এ ভাগনাকে নিয়োগ কমিটির প্রধান হিসেবে পেলে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন। ব্যবসায়িক কাজে আমাকে মাঝে-মধ্যে সে বিভিন্ন পরামর্শও দিয়ে থাকে। আমি তার পরামর্শ শুনে একা একা হাসি। লম্বা-চওড়া এ ছেলেটির মাঝে আমি ভবিষ্যৎ একজন চৌকস উচ্চতর সামরিক কর্মকর্তার প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই।
আমি আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে দৈনিক সময় দিয়ে থাকি কমপক্ষে ১৩ ঘন্টা; ক্ষেত্রবিশেষে আরও বেশী। পরিবারের জন্য খাবার আইটেমের বাজারে যাই সাধারণতঃ সপ্তাহে একদিন। পুরো সপ্তাহের জন্য খরচ করে বাসায় ফেরার পর আমার সহধর্মিনী ‘এত খরচ কেন করলাম’ বলে মাঝে-মধ্যে কান্নাও শুরু করে দেয়। সে চায় আমি যেন প্রতিদিন অল্প অল্প পরিমাণ খরচ করে সাশ্রয় করি। আয় হচ্ছে অল্প, তাই খরচও করতে হবে অল্প অল্প করে। এ অবস্থা চলছে প্রায় দশ বছর থেকে। তার দৃষ্টিতে এভাবে বাজার না করে ‘যখন প্রয়োজন, যতটুকু প্রয়োজন’ অনুপাতে বাজার করলে অনেক টাকা সাশ্রয় হতো। আমার পক্ষে দৈনিক তিনবার বাজারে যাওয়া প্রায় অসম্ভব; আবার দৈনিক তিনবার বাজারে গেলে যে সাশ্রয় হবে, তাও আমি অংক কষে হিসাব মিলাতে পারি না। যদিও আমি অংকে খুব ভাল ছাত্র ছিলাম। প্রতি সপ্তাহে চোখের পানি দিয়ে ভেজা তার পরামর্শ আমার পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব হয় না। আমি তার আন্তরিক পরামর্শে প্রচন্ড বোকামীর গন্ধ পাই। সে øাতক ডিগ্রীধারী ধর্মপরায়ন একজন আদর্শ গৃহিনী। সে একটি হাদীছের উদৃতি দিয়ে হাদীছের আলোকে আমাকে চলতে পরামর্শ দেয়। মহানবী (স.) বুদ্ধিমানের সাথে পরামর্শ করে বুদ্ধিহীনদেরকে চলার তাগিদ গিয়েছেন। তার মতে আমার যেহেতু জ্ঞান-বুদ্ধি খুবই কম, সেহেতু হাদীছের বক্তব্যমত আমাকে তার পরামর্শমতই চলতে হয়।
আমাদের মার্কেটের ব্যবসায়ী সমিতির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০০৪ সনে। সভাপতি হিসেবে তখন নির্বাচিত হন সদ্য প্রয়াত সাংবাদিক আব্দুর রাজ্জাক। রাজ্জাক সাহেবের বেশ আন্তর্জাতিক কানেকশন থাকায় সিঙ্গাপুর থেকে একটি বিজনেস কনফারেন্সের ইনভাইটেশন কমিটির কাছে এসে পৌঁছে। রাজা ম্যানশন ব্যবসায়ী সমিতির সহ-সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হওয়ায় দশজন সফরসঙ্গীর সাথে আমিও কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করি। বেশ ক’টি ভাষায় মোটামোটি দখল থাকায় ভ্রমণকালীন সময়ের অধিকাংশ স্থানে আমাকেই গাইড হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হয়েছিল। সে সময়ে মালোয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ কয়েকটি দেশও সফর করি। অবশ্য ব্যবসার সাথে সাথে মধ্যবয়সে এসে ছাত্রজীবনে অসমাপ্ত আমার দু’টি পরীক্ষা কামিল ও বিএ দিয়ে উভয় পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হই এবং সিলেট ল’ কলেজে ভর্তি হই। ল’ কলেজ থেকে প্রিলিমিনারী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করলেও শেষ পর্যন্ত ব্যবসায়িক ব্যস্ততার কারণে এলএলবি ফাইনাল পরীক্ষাটা দেয়া সম্ভব হয়নি। মোটা অংকের অর্থের মালিক হতে না পারলেও মোটামোটি মধ্যমপর্যায়ের একজন মুদ্রণ-ব্যবসায়ী হিসেবে সিলেট শহরে মোটামোটি টিকে আছি। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তহবিলে আয়কর নিয়মিত পরিশোধ করে আসছি। সন্তান-সন্ততিরা সিলেট নগরীর উন্নতমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করছে। পরিবারে প্রচুর আর্থিক টানাপোড়েন ধাকলেও মহান প্রভুর কৃপায় শহরতলীতে বাড়ী করার উপযোগী একটি প্লটের মালিকও এখন আমি।
জীবনের শেষার্ধে এসে আজ বোকা ও বুদ্ধিমানের সংজ্ঞা মিলাতে পারছি না। আমার মতে, জ্ঞান-বুদ্ধি হলো মহান রাব্বুল আলামীন প্রদত্ত একটি নিয়ামত। প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে বড় বুদ্ধিমানও বোকা বনে যায়, আর বাস্তব একজন বোকাকে পরিচর্যা করলে তার জ্ঞান পূর্ণতা লাভ করে। সে অনেক বড় দায়িত্বও আঞ্জাম দিতে সক্ষম হয়। যার উদাহরণ আমার লেখায় উল্লেখিত আমার আপন ভাই; বড় মামার কাছে এক সময় সে ছিল অত্যন্ত বোকা আর আজ এই মামার কাছেই অত্যন্ত বুদ্ধিমান। সে আজ সিলেট নগরীর প্রতিষ্ঠিত কোটিপতি একজন ব্যবসায়ি। তবে সে বোকা ভাইটির জ্ঞানের পরিচর্যা করে বোকা থেকে বুদ্ধিমান, নিঃস্ব থেকে কোটিপতি বানিয়ে এ পর্যন্ত নিয়ে আসার যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে পেরেছিলাম বলে নিজেকে আজ ভাগ্যবান মনে করছি।
শেষকথা-প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়া কোন ব্যক্তির একটি কাজে ব্যর্থ হওয়া দিয়ে তার জ্ঞান-বুদ্ধির পরিমাপ করা ঠিক নয়। হয়ত তার মাঝে আরো অনেক প্রতিভা লুকিয়ে আছে। প্রতিভা বিকাশের সুযোগ করে দিলে সে নিজের এবং দেশের জন্য অনেক মঙ্গল বয়ে নিয়ে আসতে পারে। জ্ঞান-বুদ্ধি কম বলে কাউকে অবহেলা বা তিরষ্কার করবেন না, বলাতো যায় না-সময়ের পরিক্রমায় একদিন হয়ত আপনি তার কাছে আশ্রয়প্রার্থী অথবা সাহায্যপ্রার্থী হতে পারেন।
মঈনুল হক মঈন, স্বত্তাধিকারী-মঈন কম্পিউটার প্রিন্টার্স, রাজা ম্যানশন (২য় তলা), জিন্দাবাজার, সিলেট।


Spread the love

Leave a Reply