শ্রমিকের অধিকার ও ইসলামের দিকনির্দেশনা

Spread the love

শ্রমিকের অধিকার ও ইসলামের দিক ...

ওয়াহিদ মুহাম্মাদ মাহবুব:

শিল্প বিপ্লবের আগে থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য অধিকার ও শ্রমের সঠিক মূল্য পাওয়ার জন্য প্রায়ই শ্রমিক ধর্মঘটের ডাক দিয়ে থাকেন, যা দেশে-বিদেশে একটি পরিচিত ঘটনা। ইউরোপের দেশগুলোতে প্রতি বছরই আন্ডার গ্রাউন্ড, বাস ও রেল শ্রমিকরা তাদের বেতন বৃদ্ধি, ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির জন্য এই ধর্মঘট করে থাকে। এইতো লক ডাউন চলাকালীন সময়েও বাংলাদেশে গার্মেন্টস শ্রমিকরা সাভার, গাজীপুর ও ময়মনসিংহে, আবার সাকিবের অ্যাগ্রো ফার্মে তারা তাদের বকেয়া বেতন আদায়ের জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করল। ক্ষুধা এমনই এক মানবীয় চাহিদা যা কোন বিধি নিষেধ শুনতে ও মানতে চায় না, তাইতো আমরা দেখতে পেলাম লক ডাউন ক্ষুধার্ত মানুষকে ঘরে আবদ্ধ রাখতে পারেনি। তবে মানুষ শুধু ক্ষুধার্ত পেট নিয়েই জন্মায় না, সাথে দুটি কর্মক্ষম হাত নিয়েও জন্মায়। শ্রমিকের হাত রাসুলে আকরাম(স) এর কাছে ছিল খুবই প্রিয় ও সম্মানিত। একদা জনৈক সাহাবী তার দুটো হাত রাসুল(স) দেখালেন যে কাজ করতে করতে তার হাতখানা ফেটেই গেছে। রাসুল(স)তখন ওই সাহাবীর হাতকে কাছে টেনে নিয়ে ওই হাতের উপর চুম্বন করে তাকে সম্মানিত করেছিলেন।

১৮৮৬ সালের মে মাসের ৪ তারিখে শিকাগোর হাইমার্কেট এলাকায় শ্রমিকরা আট ঘন্টা কর্মদিবস আদায়ের সমর্থনে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও র্যালি করেছিলো, যার উপর পুলিশ অতর্কিত হামলা করে এক শ্রমিককে হত্যা এবং বেশ কয়েকজন শ্রমিককে আহত করেছিলো। এই ঘটনা ইতিহাসে হাইমার্কেট গণহত্যা, হাইমার্কেট দাঙ্গা, বা হাইমার্কেট স্কয়ার দাঙ্গা নামেও পরিচিত। এই ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ১৯০৪ সাল থেকে তৎকালীন শ্রমিক সংগঠনগুলো প্রতি বছর শ্রমিক দিবস পালনের উদ্দ্যোগ নিলেও, অবশেষে ১৯১৩ সাল থেকে প্রতি বছর ১লা মে শ্রমিক দিবস পালন করছে বিশ্বের মেহনতি মানুষ।আজ পৃথিবীর অনেক দেশেই ১লা মে সরকারি ছুটি পালন করা হয়।

প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের পরপরই পশ্চিমা বিশ্ব বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, কেবলমাত্র সামাজিক ন্যায় বিচারের মাধ্যমেই সমাজে শান্তি আনয়ন সম্ভব। তাই সিরিজ আলোচনা, সমালোচনা, পরামর্শ শেষে “Treaty of Versailles” চুক্তির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সংস্থা League of Nations শ্রমিক কল্যানের অঙ্গিকার নিয়ে ১৯১৯ সালের অক্টোবর মাসে গঠন করে International Labour Organisation (ILO); যার মূলমন্ত্র ছিল সরকার, মালিক ও শ্রমিক এক সাথে কাজ করে শ্রম কল্যাণ নিশ্চিত করা। ILO কন্সিটিউশনে ঘোষণা করা হয় “Universal and lasting peace can be established only if it is based upon social justice”। ILO শ্রম কল্যাণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশে পরিচালনা করে ভিন্ন ভিন্ন কর্মসূচী। ১৮৭টি সদস্য রাষ্ট্রের সমন্নয়ে ২০১৯ সালে সংস্থাটি পালন করল তাদের শত বার্ষিকী। বর্তমানে সংস্থাটি ৭৬০টি প্রোগ্রাম পরিচালনা করছে ১০০টির মতো দেশে।

উনিশ শতকের প্রথম দিকে এসে আন্তর্জাতিক বিশ্ব শ্রমিকের অধিকারের বিষয় নিয়ে কথা বলা শুরু করেছে, অথচ, সাড়ে চৌদ্দশো বছর আগে থেকেই বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত, গরিব, দুঃখী ও শ্রমিকের বন্ধু নবী কারীম(স) শ্রমিকের অধিকারের ব্যাপারে সুন্দর দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন।

ইসলাম প্রতিটি মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের প্রত্যাহিক জীবনের এমন কোন দিক নেই যার আলোচনা ও দিকনির্দেশনা দেয়নি। ইসলাম হোল একটি শাশ্বত জীবন ব্যবস্থা যেখানে আলোচনা করা হয়েছে মানবাধিকার, পিতা-মাতার অধিকার, আত্মীয়ের অধিকার, এতিমের অধিকার, প্রতিবেশীর অধিকার, নন-মুসলিমের অধিকার, প্রাণীকুলের অধিকার, বৃক্ষরাজির অধিকার; ঠিক তেমনি আলোচনা করা হয়েছে শ্রমিকের অধিকারও। এজন্য ইসলামকে বলা হয় Scientific, Pragmatic, and Practical জীবন ব্যবস্থা।

ন্যায়বিচার এবং ন্যায্য আচরণ হল ইসলামের প্রাথমিক মূল্যবোধ, যাকে সবসময়েই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে সর্বক্ষেত্রে। ন্যায়বিচার ছাড়া সমাজে কখনই শান্তি ও সম্প্রীতির আনয়ন সম্ভব নয়।ন্যায়বিচার প্রয়োজন সকল মানুষের জন্য, তথা সমাজ ও রাষ্ট্রের বৃহত্তর কল্যাণের জন্যই। আল্লাহ তায়লা মানুষকে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার জোর তাগিদ দিয়েছেন কুরআনের বিভিন্ন অংশে, যেমন “হে ইমানদারগণ, তোমরা সর্বদা ইনসাফ, ন্যায়বিচারের পক্ষে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত থেকো” (আন-নিসাঃ১৩৫) ।

ন্যায়বিচার করতে হলে মানুষের মন-মগজ থেকে শ্রেণী বিভেদ তুলে দিতে হবে সর্বাগ্রে। মালিক-শ্রমিক, উঁচু-নীচু, নারী-পুরুষ, তরুণ-বৃদ্ধ, ধনী-দরিদ্র, সাদা-কালো, দেশি-বিদেশীর মধ্যে কোনো বৈষম্য না করার জন্য এবং প্রত্যেককে তার প্রাপ্য সম্মান করার জন্য নবী করিম (স) তার বিদায় হজের ভাষণে বিশেষভাবে তাগিদ দিয়ে গেছেন। এই প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়লা বলেছেন-“হে মানবজাতি! আমি তোমাদেরকে একটি পুরুষ ও একটি নারী থেকে সৃষ্টি করেছি, তারপর আমি তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও উপজাতিতে পরিণত করেছি, যাতে তোমরা একে অপরকে জানতে পারো, নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকটে তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক সম্মানিত ব্যক্তি (তিনিই), যিনি আল্লাহকে বেশী ভয় করেন, আল্লাহ সব কিছু জানেন এবং সব বিষয়ে খবর রাখেন ” (হুজুরাতঃ১৩)। সুতরাং, শ্রমিককেও দিতে হবে তার প্রাপ্য সম্মান, মর্যাদা আর অধিকারের সবটুকুই।

ইসলাম সর্বদাই কাজ করে জীবিকা উপার্জনকে উৎসাহিত করেছে, ভিক্ষাবৃত্তি কে করেছে নিরুৎসাহিত। বলা হয়েছে, যারা নিজ হাতে হালাল ও বৈধ পথে উপার্জন করে জীবিকা নির্বাহ করে, তারা তয়ামদের মধ্যে সর্বাদিক সম্মানিত। বৈধ পথে উপার্জন শতভাগ নির্ভর করে কর্মচারী, শ্রমিক,ও মালিকের সুন্দর সুষম সম্পর্কের উপর । প্রত্যেক পক্ষকেই পালন করতে হবে তার নিজ নিজ দায়িত্ব সঠিক ভাবে। শ্রমিকের যেমন অধিকার রয়েছে তার মালিকের উপর, ঠিক তেমনি মালিকেরও অধিকার রয়েছে তার অধীনস্থ কর্মচারীর উপর। ইসলামি নির্দেশনা মতে নিম্নোক্ত পদক্ষেপের মধ্যমে কর্মচারী বা শ্রমিক তার অধিকার সমুহ আদায় করতে পারে;

১। চুক্তির অধিকারঃ ইসলাম বরাবরই চুক্তির উপর জোর দিয়েছে যখন দুটি পক্ষের মধ্যে কোন অর্থনৈতিক লেনদেন হবে। শ্রমিক ও মালিকের মধ্যে একটি চুক্তি থাকতে হবে, মৌখিক বা লিখিত যাই হোক না কেন। চুক্তির সমস্ত শর্ত, উপশর্ত, সময়, বিধি-বিধান স্পষ্ট এবং স্বচ্ছ হতে হবে। চুক্তিগুলি অবশ্যই ন্যায়সঙ্গত এবং বৈধ হতে হবে।কর্মচারীদের তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য যেমন চুক্তিতে বর্ণিত থাকবে, তেমনি ক্ষতিপূরণ, ছুটি, অবকাশ কালীন ভাতা, মাতৃত্ব কালীন ছুটি, ভাতা, কর্ম ঘণ্টা, বেতন, বোনাস, অসুস্থ কালীন বেতন-ভাতা ইত্যাদির সম্পূর্ণ বিবরন চুক্তিতে উল্লেখ থাকতে হবে। পাশাপাশি মালিকের করণীয়, দায়িত্ব ও কর্তব্যও উল্লেখ থাকেতে হবে চুক্তিতে। আর এই চুক্তি সম্পাদন করা শ্রমিকের একটি আইনগত, কুরআন প্রদত্ত ইসলামীক অধিকার। আল্লাহ তায়লা বলেছেন – “ হে মানুষ, তোমরা যারা ঈমান এনেছো তোমরা ওয়াদা/চুক্তি সমূহ পুরন করো” (মায়েদাঃ১)। চুক্তির গুরুত্ব তুলে ধরতে গিয়ে কুরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে – “ হে ইমানদার ব্যক্তিরা, তোমরা এমন কথা কেন বল যা তোমরা নিজেরা পালন করোনা। আল্লাহর কাছে এটি বড়ই অপছন্দের কাজ যে, তোমরা এমন কথা বলে বেড়াবে যা তোমরা নিজেরাই করবে না ” (সফঃ২-৩)।নবীকরীম(স) চুক্তির গুরুত্ব তুলে ধরতে গিয়ে বলেছেন “মুসলমানদের অবশ্যই তাদের চুক্তি মেনে চলতে হবে, যদি না এমন কোন চুক্তি হয়; যা হারামকে হালাল করে বা হালালকে হারাম করে তোলে” (তিরমিযী)। আরও বলা হয়েছে যে ইসলাম এমন কোন চুক্তিকে অনুমোদন করে না, যা কোনো পক্ষের জন্যই ন্যায়সঙ্গত নয়। মালিক ও কর্মচারী উভয়কে চুক্তির শর্ত পুরনে হতে হবে সচেষ্ট ও আন্তরিক। এতে উভয় পক্ষই তাদের নিজ নিজ অধিকারটুকু পুরোপুরি বুঝে নিতে পারবে। কেউই ক্ষতিগ্রস্থ হবে না।

২। সামাজিক মর্যাদার অধিকারঃ বৈধ ও হালাল প্রতিটি কাজকেই ইসলাম সম্মানের চোখে দেখে। ইসলাম যে কোন বৈধ পেশা ও ব্যবসা করার অধিকার প্রদান করেছে প্রতিটি মানুষকে। তবে মালিকের প্রতি রয়েছে অতিরিক্ত নির্দেশনা যে, মালিককে তার অধীনস্থ কর্মচারীর সাথে সম্মানজনক ব্যবহার করতে হবে। কোন অবস্থায়ই অবমাননাকর, অসম্মানজনক, ও কষ্টদায়ক আচরণ ও ব্যবহার করা যাবে না। কুরআনের নির্দেশনা হচ্ছে – “আর তোমরা সবাই আল্লাহর ইবাদত করো৷ তাঁর সাথে কাউকে শরীক করো না৷ পিতা-মাতার সাথে ভালো ব্যবহার করো৷ নিকট আত্মীয় ও এতিম-মিসকিনদের সাথে সদ্ব্যবহার করো৷ আত্মীয় প্রতিবেশী, অনাত্মীয় প্রতিবেশী, পার্শ্বসাথী, মুসাফির এবং তোমাদের মালিকানাধীন বাদী ও গোলামদের প্রতি সদয় ব্যবহার করো৷ নিশ্চিতভাবে জেনে রাখো, আল্লাহ এমন কোন ব্যক্তিকে পছন্দ করেন না, যে আত্মঅহংকারে ধরাকে সরা জ্ঞান করে এবং নিজের বড়াই করে৷” (নিসা-৩৬)। সুতরাং, সম্মানজনক ব্যবহার পাওয়া শ্রমিক, কর্মচারীর এবং অধীনস্থদের কুরআন প্রদত্ত একটি অধিকার।

৩। সদয় ব্যবহারের অধিকারঃ রাসুল কারিম(স)এর বিদায় হাজ্জের ভাষণ থেকে এটি প্রতীয়মান যে মালিক ও শ্রমিক ভাই ভাই। মালিকরা যেই কাজ তার নিজের জন্য পছন্দ করবে না, সেই কাজ তার শ্রমিককেও দেবে না। বিশেষ করে শ্রমিকদের তাদের সামর্থ্যের বাইরে কাজ দেওয়া যাবে না। কাজের জন্য মানবিক এবং নিরাপদ পরিবেশের নিশ্চয়তা বিধান করা। চাকরিরত অবস্থায় কোন কর্মচারী আহত হলে তাদের ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা। পাশাপাশি শিশু ও বাল্যশ্রম নিরুৎসাহিত করা।

মহিলা শ্রমিকেরা যাতে হিজাব/পর্দা সহকারে কাজ করতে পারে সেই পরিবেশের নিশ্চয়তা বিধান করা। তাদের সামর্থ্যের অধিক কাজে বাধ্য করা যাবে না এবং তাদের কর্মসংস্থানে মাতৃত্বকালীন সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। নবী করীম (স)এই প্রসঙ্গে বলেছেন- “ আপনার ভাইয়ের প্রতি আপনার দায়িত্ব রয়েছে। আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে আপনার অধীনস্থ করেছেন। সুতরাং যার কাছে এরূপ ভাই আছে, সে যেই খাবার ও পোশাক তার নিজের জন্য পছন্দ করে, তা যেন তার ভাইকেও দেয়। তাদের উপর এমন কোন কাজ চাপিয়ে দিবেন না যা সে করতে সমর্থ নয়, এবং যদি এরূপ কাজ তাদেরকে দিতেই হয়, তবে তাদের কাজে সহায়তা করতে হবে” (বুখারী)।

৪। যথাযথ ও সময়মতো মজুরি পাওয়ার অধিকারঃ শ্রমিকদের যথাযথ, ন্যায্য ও সময়মত মজুরি প্রদান করতে হবে। শ্রমিক ও মালিকের মধ্যে একটি সুন্দর ও কর্ম পরিবেশ বান্ধব সম্পর্ক থাকতে হবে। মালিকপক্ষ কখনই তার অধীনস্থ কর্মচারীকে শোষণ করতে পারবে না। ইসলাম কোনও ব্যক্তির দ্বারা অপর ব্যাক্তিকে শোষণ অনুমোদন করে না, যা একেবারেই অনুমোদিত নয়। আল্লাহ বলেন, “আর মাদইয়ানবাসীদের কাছে আমি তাদের ভাই শোআইবকে পাঠাই৷ সে বলেঃ হে আমার সম্প্রদায়ের লোকেরা! আল্লাহর ইবাদত করো, তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ নেই৷ তোমাদের কাছে তোমাদের রবের সুষ্পষ্ট পথনির্দশনা এসে গেছে৷ কাজেই ওজন ও পরিমাপ পুরোপুরি দাও, লোকদের পাওনা জিনিস কম করে দিয়ো না৷ এবং পৃথিবী পরিশুদ্ধ হয়ে যাওয়ার পর তার মধ্যে আর বিপর্যয় সৃষ্টি করো না৷এরই মধ্যে রয়েছে তোমাদের কল্যাণ ,যদি তোমরা যথার্থ মুমিন হয়ে থাকো” (আরাফঃ৮৫)। আর আমাদের সবারই জানা সেই হাদিস যেখানে নবীকারিম(স)বলেছেন, “শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগে তার মজুরি দাও”, (ইবনে মাজাহ)। সুতরাং, যথাসময় ন্যায্য মুজুরি পাওয়া শ্রমিকের একটি অধিকার। দিনের শেষে বা মাসের শেষে শ্রমিক যখন তার প্রাপ্য মজুরি পায়, তখন তার চোখে মুখে বয়ে যায় এক তৃপ্তি ও প্রশান্তির হাসি। মালিককে সেই দিকে খেয়াল রাখতে হবে।

৫। ন্যায্য শ্রম ঘণ্টা ও কাজের পরিবেশঃ ইসলাম সর্বদাই কাজের পরিবেশ, ঘণ্টার উপর জোর দিয়েছে। কোন অবস্থাতেই অতিরিক্ত ও শ্রমিকের ইচ্ছার বিরেদ্ধে কাজ করাতে বারন করেছে। নবী শুয়াইব (আঃ) তার জামাতা মুসা (আঃ) কে বলেছিলেন “আমি আমার এ দু’মেয়ের মধ্য থেকে একজনকে তোমার সাথে বিয়ে দিতে চাই৷শর্ত হচ্ছে, তোমাকে আট বছর আমার এখানে চাকরি করতে হবে৷ আর যদি দশ বছর পুরো করে দাও, তাহলে তা তোমার ইচ্ছা৷ আমি তোমার ওপর কড়াকড়ি ও কষ্টকর শর্ত আরোপ করতে চাইনা; তুমি আমাকে সদাচারী ব্যক্তি হিসেবেই পাবে ইনশাআল্লাহ”(কাসাসঃ২৭)। শ্রমিকদের দ্বারা অতিরিক্ত কাজ, ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ ও রুগ্ন পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য করাকে নিষেধ করেছেন, কেননা অতিরিক্ত কাজের কারনে যদি শ্রমিকের কোন ক্ষতি হয়, তাহলে কেয়ামতে দিন মালিককে এর জন্য জবাবদিহি করতে হবে। সুতরাং, ন্যায্য শ্রমঘণ্টা শ্রমিকের একটি অন্যতম মৌলিক অধিকার।

৬। সামাজিক নিরাপত্তাঃ সামাজিক নিরাপত্তা বিধানে যাকাত একটু গুরুত্বপূর্ণ tools হিসাবে বিবেচিত হয়। ইসলাম কেবল সমাজে সম্পদের ন্যায়সঙ্গত বন্টন করার কথা বলেনি, বরং, সাথে সাথে জনগণকে জীবনযাত্রার মৌলিক মান ও অধিকার দিয়েছে।এজন্য ধনী ব্যক্তিদের উপর যাকাতকে ফরয করা হয়েছে যাতে এর মাধ্যমে জীবনধারণের প্রাথমিক মান নিশ্চিত করা যায়। “সম্পদ তোমরা এমন ভাবে বণ্টন করবে যেন তা কেবল তোমাদের সমাজের বিত্তশালিদের মাঝেই আবর্তিত না হয়” (হাশর-৭)। যাকাত সমৃদ্ধদের কাছ থেকে নিয়ে, তারপরে তা দরিদ্রদের মাঝে বিতরনের মধ্য দিয়ে ন্যূনতম জীবনযাত্রার মান নিশ্চিত করা। বর্তমান ইসলামী আইনবিশারদদের মতে যাকাত বেকারদের প্রশিক্ষণ প্রদান এবং চাকরি পুনর্বাসন কর্মসূচিতেও ব্যবহৃত হতে পারে। Income Support Programme হিসেবেও যাকাত ব্যবহৃত হতে পারে। শ্রমজীবী কর্মচারীরা হলেন সমাজের দরিদ্রতম মানুষ। তারাও যাকাতের অর্থ নিতে সক্ষম। শ্রমিকদের মধ্যে যথাযথভাবে যাকাত বিতরণ, শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতির জন্য একটি ভাল পদক্ষেপ হতে পারে। শ্রমিক যদি তার জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি ও দৈনন্দিন মৌলিক মানবীয় চাহিদা পুরনে অক্ষম হয়, তাহলে, মালিক ও সমাজের সামর্থ্যবানদের কাছ সামাজিক নিরাপত্তা গ্রহনের অধিকার রাখে।

৭। লভ্যাংশ বণ্টনঃ লভ্যাংশ বণ্টন ইসলামী শ্রমনীতিতে একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। উমর চাপড়া তার Islam and the Economic Challenge গ্রন্থে বলেছেন “The proponents of Islamic economic and finance systems have written extensively on the establishment of profit sharing or stock ownership schemes in firms.” অন্যদিকে এম এন সিদ্দিকি তার Issues in Islamic Banking বইতে বলেছেন “Every firm should be required to establish a profit-sharing scheme for its employees.”। সর্বাধিক মুনফা এবং শ্রমিকের কাছ থেকে ভাল কাজ আদায়ের লক্ষে শ্রমিকদের মাঝে জয়েন্ট ভেঞ্চারের মাধ্যমে লভ্যাংশ বণ্টন কে ইসলাম উৎসাহিত করেছে।

নবী কারীম (স) বলেছেন “যদি তোমার কোন ভৃত্য বা কর্মচারী তোমার জন্য খাবার প্রস্তুত করে এবং তোমার নিকট তা পরিবেশন করে, এই খাবার তৈরি ও পরিবেশন করতে গিয়ে সে যে উত্তাপের যন্ত্রণা সহ্য করেছে, এজন্য তোমার উচিত হবে তাকে তোমার সাথে বসতে এবং খাবারে অংশগ্রহন করতে বলা” (মাজমা ’আল জাওয়াইদ- ২০১৫)। এ এ জুলফিকার, তার Religious Sanctification of Labour Law: Islamic Labour Principles and Model Provisions শীর্ষক আর্টিকেল আরেকটি হাদিসের উল্লেখ করেছেন যে নবী কারীম (স) বলেছেন “শ্রমিকরা তাদের প্রচেষ্টার মাধ্যমে যে খাদ্যশস্য উৎপাদন করে, তাদের মধ্যে তার কিছু অংশ প্রদান করো, কেননা শ্রমিক হিসাবে তাদের দ্বারা উৎপাদিত শস্য হতে তারা বঞ্চিত হতে পারে না।” উপরোক্ত হাদিসের আলোকে এটি প্রমানিত হয় যে শ্রমিকের মাঝে লভ্যাংশ বণ্টন কে যেমন উৎসাহিত করা হয়েছে, তেমনি এটি শ্রমিকের অধিকারও বটে। মালিক যদি তার মুনাফার কিছুটা অংশ শ্রমিককে প্রদান করে তাহলে, শ্রমিকরা সেই প্রতিষ্ঠানে তার সর্বাধিক শ্রম দিয়ে প্রতিষ্ঠানের কল্যাণ, উন্নতি, অগ্রগতি ও মুনাফা অর্জনে ব্যাপক ভুমিকা পালন করবে।

৮।কর্মস্থলে নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকারঃ শ্রমিক যাতে তার ধর্ম-কর্ম নির্বিঘ্নে পালন করতে পারে সে ব্যপারে মালিককেই অগ্রণী ভুমিকা পালন করতে হবে। এক্ষেত্রে সমস্ত রকমের সুযোগ-সুবিধা প্রদান করতে হবে। শ্রমিক যদি কর্ম ক্ষেত্রে তার ধর্ম চর্চা করতে পারে, তাহলে সে কাজের প্রতি আরও বেশী মনোযোগী, কল্যাণকামী, নিবেদিত ও দরদী হবে; কাজে ফাঁকি দিবে না, এতে মালিকের মুনাফাই অর্জিত হবে সবচেয়ে বেশী। আল্লাহ বলেছেন “কঠিন শাস্তি তাদের জন্য, যারা পার্থিব জীবনকে পরকালিন জীবনের উপর প্রাধান্য দেয়, মানুষদেরকে আল্লাহর পথ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চায়, এই পথকে বাকা করতে চায়; তারাই গোমরাহিতে নিমজ্জিত” (ইব্রাহিম-৩)। সুতরাং, কর্মক্ষেত্রে নির্বিঘ্নে ধর্ম পালন করা শ্রমিকের একটি অধিকার।

৯। বাক স্বাধীনতা, অভিযোগ ও মকাদ্দমা করার অধিকারঃ ইসলাম শ্রমিকের কমপ্লেইন করার অধিকার নিয়েও কথা বলেছে। “আমি তোমাদের আগে অনেক কয়টি মানব গোষ্ঠীকে ধ্বংস করে দিয়েছি, যখন তারা জুলুম করেছিল” (ইউনুছঃ১৩)। নবীকারীম(স) বলেছেন, “আমি জুলুম কে আমার নিজের জন্য ও আমার অধিনস্থদের প্রতি হারাম করেছি”। মহানবী(সা) আরও বলেছেন, “আমি কিয়ামতের দিন তিন ধরণের লোকের বিরুদ্ধে কথা বলব, যে আল্লাহর নামে অঙ্গীকার করে এবং তা ভঙ্গ করে; যে একজন মুক্ত লোককে দাস হিসাবে বিক্রয় করে এবং তার মূল্য গ্রহন করে; এবং যে একজন শ্রমিককে নিযুক্ত করে ও তার কাছ থেকে সম্পূর্ণ কাজ বুঝে নেয়, কিন্তু তার মজুরি দেয় না” (বুখারী)। শ্রমিক যদি তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, বৈষম্যের স্বীকার হয়, লাঞ্ছিত হয়, অপমানিত হয়, হেনস্থার স্বীকার হয়, ও জুলুমের স্বীকার হয় তাহলে সে মালিকের বিরুদ্ধে কথা বলতে, কমপ্লেইন ও মকাদ্দমা করার অধিকার রাখে। পাশাপাশি তার অধিকার আদায়ের জন্য ইউনিয়ন গঠন ও এর সদস্য হওয়ার অধিকার রাখে।

শ্রম আন্দোলনের কিংবদন্তী ব্যক্তিত্ব Dr Martin Luthar King শ্রমিকদের মর্যাদা ও সম্মানের কথা বলতে গিয়ে এক বক্তৃতায় বলেছেন, “No work is insignificant. All labour that uplifts humanity has dignity and importance and should be undertaken with painstaking excellence.”

সবচেয়ে আধুনিক, বাস্তব সম্মত জীবন ব্যবস্থার নাম হোল ইসলাম। শ্রমিকের যেসব অধিকার ইসলাম দিয়েছে তার কিছুটাও যদি আজকের সমাজে দেয়া হতো তাহলে আমাদের মে দিবসের মতো একটি দিন প্রতিবছর দেখতে হতো না। শ্রমিক এবং মালিক পরস্পর নির্ভরশীল এবং সমাজের অবকাঠামো নির্মাণের মূল হাতিয়ার। দু-পক্ষই যদি তাদের অধিকার ও কর্তব্যটুকু আল্লাহকে ভয় করে আদায় করতে থাকেন আশা করা যায় সামাজিক ন্যায়বিচার সুপ্রতিষ্ঠিত হবে।

লেখকঃ ওয়াহিদ মুহাম্মাদ মাহবুব, সলিসিটর, ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস


Spread the love

Leave a Reply