জিয়াউর রহমান ছিলেন বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা

Spread the love

unnamed॥ জাহাঙ্গীর আলম মিন্টু ॥
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর জাতির ক্রান্তিলগ্নে সিপাহী জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে জিয়াকে বন্দীদশা থেকে মুক্ত করে ক্ষমতায় বসানো হয়। তাই তিনি বলেছিলেন ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’ অর্থাৎ গণতন্ত্র একমাত্র পথ। তার ক্ষমতার প্রতি লোভ ছিল না। তিনি ছিলেন ভাগ্যের বরপুত্র। তাই জিয়া প্রেসিডেন্ট হয়ে বলেছিলেন, ‘পরিস্থিতি আমাকে টেনে আনে’।
বাংলাদেশের মানুষ দেখলো ১৯৭১ এর ২৬ মার্চ শেষ প্রহরে (ভোর) তিনটায় তার কণ্ঠে যে রকম বেজে উঠেছিল আমি মেজর জিয়া, ঠিক তেমনি ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর শুক্রবার ভোরে আবার ইথারে বেজে উঠলো আমি জেনারেল জিয়া বলছি-..। তিনি জাতির উদ্দেশ্যে তার প্রথম সংক্ষিপ্ত ভাষণে বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জনগণ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী. বিমান বাহিনী, বিডিআর, পুলিশ আনসার এবং অন্যান্যদের অনুরোধে আমাকে সাময়িকভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মার্শাল’ল এডমিনিষ্টার ও সেনাবাহিনীর প্রধান হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়েছে। এ দায়িত্ব ইনশাল্লাহ আমি সুষ্ঠুভাবে পালন করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করবো। আপনারা সকলে শান্তিপূর্ণভাবে যথাস্থানে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করুন। দেশের সর্বস্থানে অফিস-আদালত, যানবাহনে, বিমান বন্দর, নৌবন্দর ও কলকারখানাগুলো পূর্ণভাবে চালু থাকবে। আল্লাহ আমাদের সকলের সহায় হোন। খোদা হাফেজ, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।
জেনারেল জিয়াউর রহমান অস্থায়ী ভাবে সবার অনুরোধে ক্ষমতায় এসেছিলেন, কিন্তু দেশের পরবর্তী পরিস্থিতিতে তিনি স্বপদে ফিরে যেতে পারেননি। পারেননি দেশের অবস্থার কথা বিবেচনা করে। স্বাধীনতা উত্তর মানুষের চাওয়া-পাওয়া ছিল অনেক। কিন্তু শেখ মজিবুর রহমান ক্ষমতায় এসে মানুষকে নিরাশ করেন। তার শাসন আমলে (৭২-৭৫) সাধারণ মানুষের অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট, গুম, হত্যা, ব্যাংক ডাকাতি, রাহাজানি, দুর্ভিক্ষ, দুর্নীতি, দুঃশাসনের ষ্টীম রোলার চলতে থাকে। দেশে সেইসময় পাঁচ হাজার বিরোধী দলীয় নেতা কর্মী গুম, সিরাজ শিকদারসহ হাজার হাজার রাজনৈতিক কর্মী ও মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ষী বাহিনী কর্তৃক হত্যা করা হয়। গণতন্ত্রের পথ হয় রুদ্ধ, সৃষ্টি হয় বাকশাল, সমস্ত পত্রপত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া হয়। মাত্র চারটি পত্রিকা রাখা হয়। ঐ সময়ে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীকে তার এক সাক্ষাৎকারে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। প্রয়াত স্বনামধন্য সাংবাদিক নির্মল সেন লিখলেন ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’। সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা ছড়াকার আবু সালেহ স্বাধীনতার এক বছর পর লিখলেন, ‘ধরা যাবে না, ছোঁয়া যাবে না, বলা যাবে না কথা। রক্ত দিয়ে পেলাম শালার আজব স্বাধীনতা’। ৭৪ দুভিক্ষে বিদেশ থেকে পর্যাপ্ত সাহায্য আসার পরও লাখ লাখ মানুষ না খেয়ে মারা গেল। তার পরিপ্রেক্ষিতে কবি রফিক আজাদ লিখলেন, ‘ভাত দে হারামজাদা নইলে মানচিত্র খাবো’। ঐ সময় স্বাধীনতাত্তোর রাষ্ট্র পরিচালনার গুরুদায়িত্বে নিয়োজিত শেখ মুজিবের মন্ত্রীসভা ও নেতৃবৃন্দ এবং দল লক্ষভ্রষ্ট হয়। এ জন্যই দেশজুড়ে ছিল হতাশা আর ক্ষোভ। ৭৫ এর ১৫ আগষ্ট প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবর রহমান সপরিবারে নিহত হন। আওয়ামীলীগের এক অংশ খোন্দকার মোস্তাকের নেতৃত্বে সরকার গঠন করেন। পরবর্তীতে ৭ নভেম্বর সিপাহী জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসেন। অতঃপর জেনারেল জিয়া উন্নয়ন আর উৎপাদন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশকে স্বনির্ভর দেশ হিসাবে গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেন।
দেশ পরিচালনায় দেশের জনগণের সমর্থন প্রয়োজন। তাই জিয়াউর রহমান গণতন্ত্রের প্রথম ধাপ উত্তরণে ১৯৭৭ সালে গণভোট করলেন। তিনি ১৯৭৮ সালে ৩রা জুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ১ কোটি ১০ লাখ ভোটের বিপুল ব্যবধানে আওয়ামীলীগসহ বিরোধী মোর্চার প্রার্থী মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বাধিনায়ক এম এ জি ওসমানীকে পরাজিত করে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জনগণের সরাসরি ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ভোটে পরাজিত ওসমানী পরাজয় মেনে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে অভিনন্দন জানান। তিনি ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে দেশে জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচন দেন। তাঁর দল নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। জাতীয় সংসদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ২২০টি আসন লাভ করে বিএনপি।

unnamed (1)একজন রাজনৈতিক নেতা হিসাবে রাজনীতিতে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ নতুন। একজন রাজনৈতিক নেতা হিসাবে তার জন্য এ সাধারণ নির্বাচন ছিল প্রথম ও কঠিন পরীক্ষা। তিনি সে কঠিন পরীক্ষায় মহাগৌরবে উত্তীর্ণ হন। রাজনীতিতে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন দেশের প্রবীণ রাজনীতিবিদরাও তার নিকট শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন।

তার সময়ে বাকশালী আমলের ৪টি খবরের কাগজসহ মোট ৪৪৪টি কাগজ চালু হল। ১টি দলের পরিবর্তে শুরু হলো বহুদলীয় গণতন্ত্র। ৬২টি দল তাদের কাজ শুরু করলো। প্রেসিডেন্ট জিয়া দেশের জন্য দেশবাসীর জন্য দিলেন ১৯ দফা কর্মসূচি। তিনি লক্ষ্য এবং কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলেন। তাঁর অসামান্য মেধা ও শ্রম দিয়ে জনগণকে সাথে নিয়ে তলাবিহীন ঝুড়িকে পরিণত করলেন তলাপূর্ণ ঝুড়িতে। দেশজুড়ে ১৯ দফার সাড়া পড়ে গেল।

তিনি মনোনিবেশ করলেন দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে। অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান ও স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের মানুষকে স্বাবলম্বী করে শোষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, তিনি ডাক দিয়েছেন স্বনির্ভরতার। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান জনগণের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবের জন্যে সর্বপ্রথম জোর দিলেন খাদ্য উৎপাদনে। বছরে তিনটি ফসল উৎপাদনের জন্য তিনি সারা দেশে উল্কার মত ছুটে চলতে লাগলেন। তিনি কৃষি উন্নয়নে বিদ্যুৎ চালিত সেচ ব্যবস্থা, ট্রাক্টর ও কৃষকের জন্যে কৃষি লোনের ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি ১২ হাজার খাল পুনঃ খনন করেছেন স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে। তিনি নিজ হাতে কোদাল ধরেছেন। ১৯৭৯ সালে শুরু হওয়া দুই বছরের মধ্যে ১০১০টি খাল খননের কাজ সমাপ্ত হয়। তিনি সবুজ বিপ্লবের সূচনা করেন। ১৯৮০-৮১ সালে তিনি প্রায় দুই হাজার আটশ মাইল দীর্ঘ খাল খননের কাজ হাতে নিয়েছিলো। তিনি কৃষি ও খাদ্যকে দলীয় ও গোষ্ঠীগত রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখুন বলে সবার নিকট অনুরোধ করেছেন। তার শাসনের পূর্বে এবং প্রথম দিকে ১০/১৫ লক্ষ টন খাদ্য ঘাটতি ছিলো। উৎপাদন বাড়িয়ে ২ বছরের মধ্যে ঘানায় চাল ও চিনি রপ্তানি করেন। দেশ ও জাতির উন্নয়নে এ মহান প্রেসিডেন্ট কাজ করেছেন নিরলসভাবে।

নিরক্ষরতা দূরীকরণে প্রেসিডেন্ট জিয়াই প্রথম উপলব্ধি করলেন, নিরক্ষরতার অন্ধকারে নিমজ্জিত মানুষ নিয়ে কোন উন্নয়ন তৎপরতা সম্ভব নয়। তাই চালু করলেন গণশিক্ষা। নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য ছাপালেন ১ কোটি বই। দেড় বছরে ৪০ লক্ষ বয়স্ক লোক নতুন করে লেখাপড়া শিখলেন। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার পরিবেশ ফিরিয়ে আনলেন। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে গ্রাম এলাকায় ৩৮ হাজার পরিবার পরিকল্পনা কর্মী নিয়োজিত করেন। সৃষ্টি করা হলো ১ বছরের প্রশিক্ষণ দিয়ে ২৭ হাজার পল্লী চিকিৎসক। শান্তি-শৃংখলা ফিরিয়ে আনার জন্য গ্রাম সরকার সৃষ্টি করা হলো ৬৫ হাজার গ্রামে। সৃষ্টি করলেন ৮০ লাখ গ্রাম প্রতিরক্ষা কর্মী। প্রেসিডেন্ট জিয়া প্রশাসন ঢেলে সাজান।

শিল্পক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়ানোর জন্যে সরকারি কলকারখানায় তিন শিফটে কাজ শুরু করলেন। শ্রমিকদের বেতন বাড়ানো এবং বছরে দুইটি বোনাসের ব্যবস্থা করা হলো। তার সময়ে মোট জাতীয় উৎপাদন ১৯৮১ সালে শতকরা ৭.৫ ভাগ বাড়ে। অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে রেকর্ড সৃষ্টি হলো।

অর্ধশিক্ষিত যুব সমাজকে কর্মীর হাতিয়ারে পরিণত করার জন্য যুব মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করেন। জেলায় জেলায় কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (ভোকেশনাল ইনষ্টিটিউশন) প্রতিষ্ঠা করেন। যার মাধ্যমেই ট্রেনিং নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ সারা বিশ্বে বাংলাদেশের শ্রমিকরা চাকুরি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে চলছে। ১৯৭৬ মে দিবসে শহীদ জিয়া সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশাল শ্রমিক সমাবেশে ঐতিহাসিক বক্তব্য দিয়ে শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে বলেন, “আমিও একজন শ্রমিক এবং এই পরিচয় দিয়ে আমি গর্বিত”। সর্বপ্রথম মধ্যপ্রাচ্যসহ বহিঃর্বিশ্বে শ্রম বাজার প্রতিষ্ঠা করেন জিয়াউর রহমান। শহীদ জিয়া মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন জাতীয় কবির অমর বাণীতে ‘ বিশ্বে যা কিছু চিরকল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর’। মহিলা ও নারীদের উন্নয়নে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন মহিলা মন্ত্রনালয় ও জাতীয় মহিলা সংস্থা। শিশুদের মেধা বিকাশে ১৯৭৭ সালে ১৫ ই জুলাই প্রতিষ্ঠা করেন শিশু একাডেমী। আমাদের স্বকীয় গ্রামীণ সংস্কৃতি উন্নয়নে প্রতিষ্ঠা করেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। যার মাধ্যমে মাতিয়ে তোলেন গ্রাম বাংলা। শিল্পকলা একাডেমীর মত জেলায় জেলায় শিশু একাডেমী প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি জনগণের হৃদয়ের মাঝে সুর তুলে দেন “প্রথম বাংলাদেশ আমার, শেষ বাংলাদেশ। জীবন বাংলাদেশ আমার, মরণ বাংলাদেশ।”
পররাষ্ট্রনীতিতে তিনি ছিলেন সফল। । জিয়াউর রহমান মধ্যপ্রাচ্য ও চীনসহ বহির্বিশ্বে বন্ধুত্বের সংখ্যা বাড়ালেন। সৌদি বাদশা ফাহাদের আমন্ত্রণে তিনি সফরে যান। উপহার হিসেবে নিয়ে যান কিছু নিম গাছের চারা! উপহার দেওয়ার সময় বলেন গরীব মানুষের দেশের গরীব রাষ্ট্রপতির পক্ষ হতে আপনার জন্য সামান্য উপহার। বাদশা ফাহাদ বহুদেশ হতে বহু মূল্যবান উপহার পেয়েছেন; কিন্তু এমন মূল্যবান উপহার আর পাননি। আবেগে আপ্লুত বাদশা জড়িয়ে ধরেন জিয়াকে। তিনি বলেন, আজ হতে সৌদি আরব এবং বাংলাদেশ পরস্পর অকৃত্রিম বন্ধু। তিনি বাংলাদেশে অর্থ সাহায্য দিতে চান। জিয়া এসময় বলেন, আমাদের দেশের মানুষ গরীব, কিন্তু তারা পরিশ্রম করতে জানে। আপনার দেশে এখন উন্নয়ন কাজের জন্য হাজার হাজার শ্রমিক দরকার। একটি নব্য স্বাধীন মুসলিম দেশের জন্য যদি আন্তরিকভাবে সাহায্য করতে চান, তবে আমার দেশের বেকার মানুষদের কাজ দিন। বাদশা ফাহাদ রাজি হলেন। খুলে গেল নতুন এক নতুন দিগন্ত। আর জিয়ার দেয়া সেই উপহার? সেই নিমের চারাগুলো আজ মহীরুহ। লড়াকু বাংলার গাছগুলো মরুভূমির সাথে লড়াই করে টিকে গেছে। আরাফাতের ময়দানে তারা আজ সবুজ শীতল ছায়া প্রদান করে চলছে। তবে সৌদিয়ানরা কিন্তু এই গাছগুলোকে ভিন্ন নামে চিনে তরধ ঞৎবব হিসেবে।

এছাড়া তার গতিশীল নেতৃত্বের কারণেই প্রাচ্যের সবচাইতে শিল্পোন্নত ও শক্তিশালী দেশ জাপানের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বাংলাদেশ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়। দেশবাসীর জন্য এটা ছিল এক বিরল সম্মান। প্রেসিডেন্ট জিয়া ইসলামী সম্মেলনে তিন সদস্য বিশিষ্ট দল ‘আল কুদস’ কমিটির একজন সদস্য হবার দুর্লভ সম্মান লাভ করেন। ইরাক-ইরান যুদ্ধাবসানের প্রচেষ্টায় ইসলামী সম্মেলনে গঠিত ৯ সদস্যের শান্তি মিশনে শীর্ষ নেতার ভূমিকা পালন করেছিলেন। তার আমলেই সৌদী আরব, চীন, কোরিয়া, পাকিস্তান ও আরো কয়েকটি দেশের সাথে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। তার আমলে দেশে দেশে মৈত্রীর বিস্তার শুরু হয়। সার্কের প্রতিষ্ঠাতাও ছিলেন জিয়া।

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়া গ্রামীণ মহিলাদের মাধ্যমে পরিবারের ও দেশের উন্নয়নে ছোট ছোট কুটির শিল্প, হাঁস, মুরগী, মাছ চাষসহ আঙ্গিনায় আঙ্গিনায় ভরে তুলতে চেয়েছেন বৃক্ষ রোপণ, আর মাচাংভরা লাউ, কুমড়া, শিম, কাকড়োল, পুকুর আর খালপাড় গাছে গাছে ভরে তুলতে চেয়েছেন আম, জাম, কাঠাল, ডাব, লেবু আর পেঁপে দিয়ে। মাঠের পর মাঠ দৌড়ে খেত খামার মাড়িয়ে তিনি ছুটে বেড়িয়েছেন গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। মাসের ২০ দিনেই রাজধানীর বাহিরে গ্রামে ছুটে বেড়িয়েছেন। দৈনিক ১৮ থেকে ২০ ঘন্টা পর্যন্ত কাজ করেছেন। তিনি দেখতে চেয়েছেন স্বনির্ভর বাংলাদেশের মানুষের মুখের হাসি।
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ছিলেন একজন সৎ, আদর্শবান, মহৎ ও ধার্মিক মানুষ। তিনি ছিলেন স্বল্পভাষী ও নিরহংকার। একজন প্রেসিডেন্ট হয়েও তিনি খলিফা ওমরের মত সাদাসিধে জীবন যাপন করতে ভালবাসতেন। তিনি ছিলেন সকল সৎ চরিত্রের গুণাবলীর অধিকারী। আনুষ্ঠানিকতা এবং প্রেসিডেন্ট চেয়ারের দাবিতে জিয়া সবসময়ই ভাল কাপড় পরতেন। কিন্তু ঘরের ভিতরে তিনি ছেঁড়া কাপড় তালি দিয়ে রিপু করে ব্যবহার করতেন।

“ মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, হুজুর আপনাকে তো সবসময় সরকার বিরোধী ভ’মিকায় দেখা যায়। এমনকি যখন আপনার নিজের দল মন্ত্রিসভা গঠন করেছিল,তখনও আপনি একই জনসভায় দাঁড়িয়ে আপনার পাশে বসা মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে হুশিয়ার উচ্চারণ করে বক্তৃতা দিয়েছেন। অথচ দেখা যায়, আপনি জিয়াউর রহমানের প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিশীল। জিয়ার প্রতি এই দুর্বলতার কারণ কি?” মওলানা সাহেব জবাবে বলেছিলেন,“ দেখ, তোমরা তো রাজনীতি দেখছ বহুদিন ধরে। আমার রাজনীতি জীবনও বহুদিনের। এমন একটা লোকতো দেখলাম না, যে ক্ষমতার শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছে নিজেকে দুর্নীতি আর স্বজনপ্রীতির ঊর্ধ্বে রাখতে পেরেছে; আমাকে একটা উদাহরণ দেখাও”। সূত্র-প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক অধ্যাপক আবদুল গফুর।

তার শাহাদাত বরণের পর জাতীয় দৈনিকের বিবরণে জানা যায় ‘জিয়ার ব্যক্তিগত মালামালের মধ্যে নিম্নলিখিত জিনিসগুলো পাওয়া যায়, একটা পুরাতন চামড়ার সুটকেস। তাহা পুরাতন যে, উহার তালাও সঠিক কাজ করে না। একটি পুরাতন অতি সাধারণ টু-ইন-ওয়ান, তালাবদ্ধ একটি পুরাতন ইকোলাক জাতীয় ব্রিফকেস, গায়ের আধা ছেড়া গেঞ্জী, ২/৩টি সাফারী শার্ট, একটি প্যান্ট, একটি ফাউন্টেনপেন, একটি সনাগ্লাস। মৃতের মাথার কাছে পড়েছিল কয়েকটি ক্যাসেট, তাহার বিছানার পার্শ্বেই পড়েছিল জায়নামাজ ও সাদা গোল টুপি। (ইত্তেফাক, ৪ জুন ১৯৮১)

দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, আইন-শৃঙ্খলা ও সার্বিক উন্নয়নে জিয়াউর রহমান মাত্র ৫ বছরের অধিক সময় শাসনামলে ১০০% সফল।। জনৈক বিদেশী সাংবাদিক তার সততা সম্পর্কে এক মন্তব্যে বলেছেন, ‘শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়ার সততা শুধু বাংলাদেশের রাজনীতিকদের জন্য অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত নয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশের রাজনৈতিকদের জন্য অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত (বাংলাদেশ টাইমস, ৯ নভেম্বর, ১৯৮১)’। শহীদ জিয়ার সততার খ্যাতি বিশ্বজোড়া। যার উদাহরণ ৩০শে মে ১৯৮১ সালে তার মৃত্যুর পর মানিক মিয়া এভিনিউতে ৩০ লাখ মানুষের ঐতিহাসিক জানাযা।

ফুটনোট ঃ শহীদ জিয়ার সবচাইতে বড় সৃষ্টি বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদের রাজনীতি বাংলাদেশ জাতীয়বাদী দল (বিএনপি) গঠন করা। তিনি বিশ্বাস করতেন দেশপ্রেম সকলের ঊর্ধ্বে, এবং বলতেন, “ব্যক্তির চেয়ে দল, দলের চেয়ে দেশ বড়”।
তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক এবং তের শতকের বাংলা বিজয়ী ইখতেয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজির মত ক্ষনজন্মা মহাপুরুষরুপে আত্মপ্রকাশ করেন জিয়া। তিনি ৭১‘র স্বাধীনতা ঘোষণা ও মুক্তিযুদ্ধ হতে ৩০ মে ১৯৮১ শাহদাৎ পর্যন্ত মাত্র ১০ বছর তাঁর কর্মময়, উৎপাদন, উন্নয়নে যাদুর পরশ লেগে আছে।

আওয়ামীলীগ ও তার দোসররা ক্ষমতায় এসে বার বার জিয়ার প্রতিষ্ঠিত বি এন পি পরিবারকে ধ্বংস করার হীন পরিকল্পনায় ব্যস্ত হয়ে উঠে। ১/১১-এর ধারাবাহিকতায় দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমান, আরাফাত রহমান কোকো এবং বিএনপি‘র নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে একের পর এক মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক মামলা দিয়ে জেল জুলুম, হয়রানি ও নির্যাতন করে যাচ্ছে। ১/১১ সরকারের মিথ্যা মামলায় আরাফাত রহমান কোকো জেলে থাকারপর উচ্চ আদালতের অনুমতি নিয়ে চিকিৎসার জণ্যে ব্যাংকক,মালেশিয়া,সিংগাপুর যান। তিনি দীর্ঘদিন ধরে শ্বাসকষ্টে ভুগেছিলেন। কিন্তু বর্তমান সরকারের দমন-নিপিড়নের ভয়ে এবং একটি সাজানো মিথ্যা মামলায় কোকোর সাজা হওয়ার কারনে দেশে আসতে পারেন নাই । চিকিৎসারত অবস্তায় ২৪ জানুয়ারী ২০১৫ মালেশিয়ায় মাত্র ৪৫ বছর বয়সে তার অকাল মৃত্যু হয়। ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশে তার জানাজায় জনতার ঢল নামে। কোকোর জানাজায় জনসমুদ্র, এ যেন জিয়া পরিবারের প্রতি দেশ ও জাতির প্রাণের ভালবাসা। ক্ষমতায় আসার দুই মাসের মধ্যে ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ পিলখানা বিডিআর বিদ্রোহে ৫৬ জন আর্মি অফিসারকে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়।

আওয়ামীলীগ এবার ক্ষমতায় এসে পূর্বের ন্যায় পাঠ্যপুস্তুক হতে স্বাধীনতার ঘোষক জিয়ার নাম মুছে ফেলেছে। জিয়া আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর, জিয়া আশুগঞ্জ ফার্টিলেজার কারখানাসহ বিভিন্ন ¯হাপনায় জিয়া ও খালেদা জিয়ার নাম মুছে ফেলার পকিল্পনা বাস্তবায়নে ব্যস্ত। গত ১৩ নভেম্বর ২০১০ শহীদ জিয়ার স্মৃতিবিজড়িত ৩৮ বছরের ক্যান্টনমেন্টের মইনুল হোসেন রোডের বাড়ি হতে তিন বারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে এক কাপড়ে টেনে হিচঁড়ে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে বের করে দেয়। এজন্য সরকার মানবতা, আইন ও মানবাধিকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখালেন। আওয়ামীলীগ জীবিত জিয়ার চাইতে মৃত্য জিয়াকে বেশি ভয় পায়। কারণ জিয়ার স্মৃতি অম্লান। যারা বাংলাদেশকে সিকিম বানাতে চায়, আমাদের সীমানায় তালপট্টিতে ভারতের পতাকা উড়লে খুশি হয়, যারা বর্ডারে ফেলানীদের লাশের প্রতিবাদ করতে ভয় পায়, যারা ভারতের টিপাইমুখ বাধঁ নির্মাণ, করিডোর, ট্রানজিটসহ ভারতকে গোপনীয় চুক্তির মাধ্যমে সব দিয়ে পরাধীনতার জিঞ্জিরে দেশে জনগণকে আবদ্ধ করেছে তারা এবং তাদের দোসররা জনগণের প্রাণের জিয়াকে হত্যা করেছে। তার ধারাবাহিকতায় বিএনপিকে ধ্বংস করার অশুভ পরিকল্পনায় ৫ জানুয়ারি ২০১৪ ভোটারবিহীন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করার মাধ্যমে গণতন্ত্রকে সমাহিত করা হয়েছে বলে সাধারণ মানুষ মনে করে।

ইতিহাস তার নিজস্ব গতিতে চলে। কিন্তু বর্তমান সরকার ইতিহাস বিকৃত করে গায়ের জোরে শহীদ জিয়াউর রহমানের অবদানকে অস্বীকার করেছে এবং বিকৃত করে উপস্থাপন করেছে। ইতিহাস একদিন তাদেরকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে। সময়মত সঠিক ইতিহাস রচিত হবে। পৃথিবীতে বাংলাদেশের মানচিত্র যতদিন থাকবে ততদিন ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে স্বাধীনতার ঘোষক সফল রাষ্ট্রনায়ক ও জাতির অহংকার, দিকনির্দেশকের জায়গা শুধু শহীদ জিয়াউর রহমানের। তিনি মরেও আমাদের কাছে অমর। তাঁর বাংলাদেশে ৩৬ তম শাহাদাত বার্ষিকীতে তাঁর প্রতি সীমাহীন শ্রদ্ধাঞ্জলি ও ফুলেল শুভেচ্ছা।
(লেখক-কলাম লেখক ও রাজনৈতিক কর্মী)


Spread the love

Leave a Reply