শেষ দেখা হলনা..

Spread the love

“ আমরা তো আল্লাহরই এবং আর নিশ্চয়ই আমরা তারই দিকে প্রত্যাবর্তনকারী”।হবিগন্জের আইনপেশা, সালিসী বিচারে ন্যায়ের পক্ষে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনকারীর , ক্রীড়া ও শিক্ষাঙ্গনের উজ্জল নক্ষত্র, দলমত, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের আপনজন, সমাজ উন্নয়ন ও মানবকল্যাণে নিবেদিত প্রবীন আইনজীবি মতিন ভাই আজ দুনিয়ার সকল মায়া মমতা ত্যাগ করে আল্লাহর কাছে প্রত্যাবর্তন করেছেন । দেশ-বিদেশে কাদিয়েছেন তার স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও অসংখ্য ভক্তবৃন্দকে ।

জন্মিলে মরিতে হবে এটাই সত্য কিন্তু কিছু কিছু মৃত্যু মানুষকে ব্যাথিত করে, কষ্ট দেয় । হতাশার মাঝে ফেলে যায় আপনজন ও গণমানুষকে । এই বিরহ সহজে মেনে নিতে সময়ের প্রয়োজন হয় । সামাজে চলার পথে যখনই মানুষ কোন সমস্যায় পতিত হয় তখনই অকালে ঝড়ে যাওয়া আপনজনের কথা, ন্যায় বিচারকের কথা ও মানবহিতৈষীদের কথা মনে করে । সমাজ উন্নয়ন ও জনকল্যাণে মতিন ভাইয়ের অবদানের কথা হবিগন্জের সচেতন মানুষ স্মরন করবে বহুকাল । মতিন ভাই আমার আপন অগ্রজদের সাথে ছিলেন ভীষন ঘনিষ্ট । সেই সুবাদে তিনি আমাদের পরিবারের একজন সদস্য হিসাবে সম্মান ও মর্য্যাদায় ভূষিত ছিলেন । আপন ভাইয়ের মতই আমরা তাকে শ্রদ্ধা করতাম । ভাল বাসতাম । আমার আপন অগ্রজদের প্রয়াণের পরে ব্যাক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও আইনী বিষয়াদী শেয়ার করতাম । সব সময়ই তার কাছ থেকে ভাল ও সৎ পরামর্শ পেয়েছি । যেকোন সমস্যায় তিনি পাশে দাঁড়াতেন, সাহায্যের হাত প্রসারিত করতেন । বিদেশ থেকে যখনই দেশে যেতাম তার সাথে সমাজ উন্নয়ন ও মানবসেবা নিয়ে আলোচনা ও মতামত শেয়ার করতাম । তার প্রয়াণে আমরা একজন সত্যিকারের শুভাকাংখী ও অভিভাবক হারালাম । তার শূন্যস্হান পূরণ হবার নয় । তিনি তৃণমূল থেকে উঠে এসে সমাজে নিজেকে একজন সৎসাহসী, স্পষ্টবাদী, জনদরদী, পরোপকারী, নির্লোভ ও নিরঅহঙ্কারী হিসাবে স্ব-প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন । আপন ক্যারিসমায় সমাজকে করেছিলেন আলোকিত । প্রবাস থেকে তার কুশলাদি জানার জন্য প্রায়ই তার সাথে টেলিফোনে আলাপ হতো আমার । গেল ঈদের দিনে টেলিফোনে সালাম দেওয়ার সময় তিনি তার সুযোগ্য মেয়ের মাধ্যমে দেশে যাওয়ার কথা ও দোয়া করতে বলেছিলেন । তারও আগে অ্যাডভোকেট নূর খান ভাই, খায়ের ভাই, গণমানুষের নেতা, শালিশ বিচারের প্রখ্যাত ন্যায় বিচারক, হবিগন্জ উপজেলার বারবার নির্বাচিত জনপ্রিয় চেয়ারম্যান সৈয়দ আহম্মেদুল হক সাহেব ও ধর্মপ্রাণ মুসলমান তথা জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সাধারন মানুষের শ্রদ্ধাভাজন শায়খুল হাদীস আল্লামা তোফাজ্জল হক সাহেবের মৃত্যুর পরে মতিন ভাই বলেছিলেন আর হয়তোবা দেখা হবে না আজিজ । আমার জন্য দোয়া করো, তোমরা সকলে ভাল থেকো । সঙ্গী-সাথী আল্লাহর কাছে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন সময় তার ফুরিয়ে যাচ্ছে । কিন্তু শেষ দেখা না হওয়ার আগেই তিনি চলে গেলেন পরপারে । সবাইকে কাদিয়ে তিনি অমন ভাবে চলে যাবেন তা ভাবিনি কখনো ।

প্রয়াত মতিন ভাইয়ের স্মৃতিচারন করে শেষ করা যাবেনা । তবুও তার বিলাত সফরের অভিজ্ঞতা নিয়ে সংক্ষেপে কিছু লিখতে হয় । ৯৫ সালে তিনি যখন প্রথম বিলাতে আসেন তখন আমার সাথে কয়েকদিন কাঠিয়েছিলেন । কথা প্রসঙ্গে আমার অগ্রজ সাবেক এম,পি মোত্তালিব সাহেব লন্ডনে কোথায় কোথায় যেতেন, লন্ডনের হাইকোর্ট, লিঙ্কনস ইন, বিবিসি সদর দপ্তর, হাউজ অব কমন্স অর্থ্যাৎ পার্লামেন্ট হাউজ, ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র ( TUC ), মহামান্য রানীর রাজ প্রাসাদ সহ উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্হান গুলো দেখতে চেয়েছিলেন । তখন আমার রেষ্টুরেন্টও ছিল ঐ সকল প্রসিদ্ধ দর্শনীয় স্হাপনা এলাকায় । ফলে তাকে নিয়ে ভ্রমন করা ছিল সহজ ও আনন্দের । যেখানেই ভ্রমন করেছেন সেখানেই স্হ্যাপত্য শিল্প দেখে ভারত থেকে সম্পদ লুন্ঠন করে কত সুন্দর করে ইংরেজরা তাদের দেশকে নির্মান করেছে তা’নিয়ে গল্পের ছলে আপসোস করতেন । লিঙ্কন্স ইন ও বিলাতের হাই কোর্টে গিয়ে ঘুরে ঘুরে সব দেখলেন । সেসব দেখতে প্রচুর সময় কাটালেন । দূরদৃষ্টি সম্পন্ন মানুষ হিসাবে তখনই হয়তোবা নিজের বড় সন্তানকে বার-এট-ল পড়ানোর কথা তার অন্তরে দোলা দেয় । পরবর্তীকালে তার বড় ছেলে সাখাওয়াত খান রিপনকে বার-এট-ল করার জন্য পাঠিয়েছিলেন বিলাতে । আলহামদুলিল্লাহ তার ছেলে সাখাওয়াতও পিতার ইচ্ছা সাফলতার সাথে পুর্ন করেছে । লিঙ্কন্স ইন থেকে ব্যারিষ্টারী পাশ করে সে দেশে গিয়ে সফলতার সাথে প্র্যাকটিস করে যাচ্ছে । দ্বিতীয় ছেলে ডারহ্যাম ইউনির্ভাসিটি থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহন করে বিলাতের এক বিখ্যাত ব্যাংকে এডভাইজার হিসাবে কাজ করছে । মতিন ভাই যখনই বিলাত সফরে এসেছেন তার সম্মানে হবিগন্জের প্রবাসীরা শতস্ফূর্ত ভাবে মতবিনিময় সভার আয়োজন করেছে । প্রতিটি মতবিনিময় সভায় তিনি মন খোলে কথা বলেছেন। বর্ণনা করেছেন কিভাবে তিনি তৃণমূল থেকে আজকের পর্য্যায়ে এসেছেন সে সব অজানা কথা । তার সম্মানে হবিগন্জ ডিষ্ট্রিক্ট ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন ইউকে কর্তৃক আয়োজিত নৈশভোজ ও মতবিনিময় সভায় অতিথ স্মৃতি বর্ণনা করেতে গিয়ে তিনি আবেগআফ্লুত হয়ে পড়েছিলেন । অকপটে বলেছিলেন তার জীবন সংগ্রাম ও বর্তমান পর্য্যায়ে তিনি কি করে পৌঁছেছেন সে সব কথা । মতবিনিময় সভা এ নৈশভোজে অংশগ্রহনকারী সকল প্রবাসী মুগদ্ধ হয়েছিল সামাজ ও দেশ বিনির্মানে প্রবাসীদের অর্থনৈতিক অবদানের কথা শুনে । তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট ও গুণের মধ্যে অন্যতম ছিল সদাহাস্যজ্জোল ভাবে তিনি পরিচিত অপরিচিত ও বয়স নির্বিশেষে সকলের সাথে মিশতে পারা, কথা বলা, সকলকে আপন করে নেওয়া, প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা । সমাজ বিনির্মান ও মানবকল্যাণে নিবেদিত সাধারন মানুষের আপন জনের মৃত্যু সংবাদ শুনে লন্ডনে প্রবাসীদের মাঝে শোকের ছায়া নেমে আসে । প্রবাসীরা তার শোকে কাতর ও মর্মাহত হয়েছেন । বিলাতের বিভিন্ন শহর থেকে হবিগন্জের প্রবাসীগণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সকলের শ্রদ্ধাভাজন ও ভালবাসার পাত্র প্রয়াত মতিন ভাইকে মহান আল্লাহতা’আলা যেন ভালবাসা দিয়ে জান্নাতুল ফেরদৌসে আশ্রয়দান করেন সে দোয়াই করেছেন । মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে শোকসন্তপ্ত পরিবারের সকল সদস্যদেরকে দৈর্য্য ও সবুর করার তৌফিক দেওয়ার জন্য সকলে প্রার্থনা করেছেন।

পঙ্কিল দূনিয়া ছেড়ে একে একে হবিগন্জের গুণীজন চলে যাচ্ছেন পরপারে । নির্মোহভাবে বিপদগ্রস্ত অসহায় ও সাধারন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর গুণীজনেরা হরিয়ে যাচ্ছেন । সম্প্রতিকালে আমরা যাদের হারিয়েছি তাদের শূন্যস্হান পুরণ করা দূরহ । মতিন ভাই সহ যারা ইহকাল ত্যাগ করেছেন তাদের সকলকে জান্নাতবীসী করার জন্য আল্লাহতা’আলার কাছে প্রার্থনা করছি । এবং যারা এখনো বেঁচে আছেন তাদের সকলের সুস্বাস্হ্য ও দীর্ঘায়ূ কামনা করছি । প্রয়াত মতিন ভাইয়ের সততা, নিষ্ঠা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ক্রীড়াঙ্গনে উন্নয়ন, সামাজিক ন্যায় বিচার ও আইনের শাসন সহ হবিগন্জ ‘ল’ কলেজ প্রতিষ্ঠায় মতিন ভাইয়ের ভূমিকা ও অবদানের মধ্য দিয়ে তিনি হবিগন্জের মানুষের কাছে স্মরনীয় হয়ে থাকবেন । প্রয়াত মতিন ভাইকে স্মরনীয় করে রাখার জন্য তার সুযোগ্য সন্তানগণ যথাযথ ভূমিকা পালন করবে বলে হবিগন্জবাসীর প্রত্যাশা ।


Spread the love

Leave a Reply